রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী:
রাত প্রায় সাড়ে দশটা । শহরের সিবি হাসপাতালের সামনে পৌছালাম। দেখলাম এক মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ। অস্থির মাকে কেউ যেন সান্তনা দিতে পারছে না। পাশেই দাঁড়িয়েছিলো সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান তানভীর হোসেন সুজন ও তার ভাই। সুজন বলল, তার মামাতো ভাই দশ দিন বাড়িতে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিল। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় হাসপাতালে আনা হলো এখন। মায়ের মন কোনভাবেই কোন সান্ত্বনা বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই ওই মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদে আশেপাশের পরিবেশ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। আমি গিয়েছিলাম ডাক্তার মানস কুমারের পরামর্শ নিতে। সঙ্গে ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু দৈনিক সাতনদী পত্রিকার সম্পাদক হাবিবুর রহমান ও আমার ক্যামেরা পারসন মামুন রেজা। মামুন এক হতভাগা মায়ের আর্তনাদ এর ভিডিও চিত্র ধারণ করেছিল। মামুনকে থামালাম। ডক্টর মানস কুমার মন্ডল সিবি হাসপাতালে পৌঁছালেন। নিজের অসুস্থতার বিবরণ দেওয়া ডক্টর প্রেসক্রিপশনে কিছুটা রদবদল করলেন। ফার্মেসি থেকে ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম। সকালে সাতক্ষীরার মাননীয় পুলিশ সুপার জনাব মোস্তাফিজুর রহমানের ফেসবুক পোস্ট পড়ে হতবাক হয়ে গেলাম। রাতে যে মায়ের আর্তনাদ শুনছিলাম , তিনি হলেন তরুণ সংবাদকর্মী সদরুল কাদির শাওনের মা। হতভাগা মায়ের মনে আগে থেকেই বার্তা চলে এসেছে, তিনি তার সন্তানকে আর ধরে রাখতে পারবেন না। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর মায়ের অবস্থা কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শাওন জাতীয় দৈনিক ভোরের পাতার স্টাফ রিপোর্টার ও স্থানীয় অনলাইন পোর্টাল আলোর যাত্রার সম্পাদক। প্রতিদিন রাতে শাওনের কাছ থেকে করোনা সংক্রমনের আপডেট তথ্য পেতাম। মেসেঞ্জারে ও পাঠাতো। গত কয়েকদিন ওর মেসেজ আর পেতাম না। জানিনা কেন ওর মেসেজ পেতাম না। আজ সকালে বুঝলাম কেন ওর মেসেজ পেতাম না। খোঁজ নিয়ে জানলাম, শাওন সাংবাদিকতা ছাড়াও এই মহামারিতে নিজেকে মানব সেবায় উৎসর্গ করেছিল। অসুস্থ মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিত অক্সিজেন সিলিন্ডার। যে অক্সিজেনে একজন অসুস্থ রোগী জীবন ফিরে পেত। কিন্তু আজ কোন অক্সিজেন শাওনের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারল না। ৩৫ বছরের তরুণ এই সংবাদকর্মীর অকাল মৃত্যুতে সান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই। শাওনের বিদেহী আত্মার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। শেষ করতে চাই, আরেকটি ঘটনা দিয়ে। কয়েক মাস আগের কথা। কলকাতার এক চিকিৎসক ফেসবুক লাইভে এসে অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বলছিলেন, করোনা আক্রান্ত রোগী এমন সময় তাদের কাছে আসছে,তখন আর তাকে ফেরানো যাচ্ছে না। আক্রান্ত রোগী যদি তিন থেকে চার দিনের মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় তাহলে তাকে সুস্থ করা সম্ভব। কিন্তু আক্রান্তের ৮ থেকে ১০ দিন পর আসলে, তাকে ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ছে। আমার এক নিকট আত্মীয় হেঁয়ালি করে বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ার কারণে শেষ মুহূর্তে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি করে ও তাকে বাঁচাতে পারিনি। দয়া করে কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন, তা না হলে এই মহামারী থেকে মানুষের জীবন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: সম্পাদক, সংকল্প নিউজ, নিজস্ব প্রতিনিধি, আরটিভি।