মো. কামাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম নগরবাসীর জীবনমরণ সমস্যা বর্ষা মৌসুমে নগরীতে জলবাদ্ধতা সৃষ্টি। একনাগারে চাঁর ঘন্টা ভারি বৃষ্টিপাত হলে চট্টগ্রাম শহর পানির তলে ডুবে যায়। পুরো নগরী জলমগ্ন নগরী হিসেবে পরিণত হয়। বর্ষার বৃষ্টিপাতকালিন যদি কর্ণফুলী নদীতে জোয়ার উঠে তাহলে পুরো নগরবাসী ঘন্টার পর ঘন্টা জলযুদ্ধে রত থাকতে হয়। একদিকে জল আর মলের সাথে ভাসতে থাকে মানুষ। অন্যদিকে চাক্তাই খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী কেন্দ্র সমূহ জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়ে শত শত কোটি টাকার মালামাল বিনিষ্ট হয়ে দেউলিয়ায় পরিণত হয়। এখন শুরু হয়েছে বর্ষার ভরা মৌসুম লাগাতার বৃষ্টি ঝরবে কোন সন্দেহ নেই। বৃষ্টি পুরো দেশের আশির্বাদ হলেও চট্টগ্রাম নগরবাসীর জন্য পরিণত হয় অভিশাপে। আজকের আকাশের অবস্থা দেখতে বুঝা যাচ্ছে লাগাতার বৃষ্টি হবে। তাতে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকায় বসবাসরত মানুষেরা আতঙ্কে ভুগছে। অনেকে বলে যাচ্ছেন ‘মরার উপর খড়ার ঘাঁ, নগরীতে জলাবদ্ধতা হওয়ার আশংকা’।
এই জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নগরবাসী আর্তনাদ করে আসছেন আশি দশক হতে। এই জলাবদ্ধতার হাত হতে রক্ষার জন্য বৃহত্তার চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির মাধ্যমে সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান চট্টলবন্ধু এস এম জামাল উদ্দিন ও মহাসচিব ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন দীর্ঘ বছর ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ১৯৯৪ সালে ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন বিলাতে চলে যাওয়া এবং ২০০৯ সালে এস এম জামাল উদ্দিনের মৃত্যু হওয়াতে এই জলাবদ্ধতা নিরসণের আন্দোলন অনেকেটা থেমে যায়। দিনদিন বৃদ্ধি পায় জলাবদ্ধতা সংকট। একেবারে হারিয়ে যায় চট্টগ্রাম নগরীর ৭২টি খালের মধ্যে ৩৪টি।
চট্টগ্রাম নগরীর চলমান সমস্যা ও জলাবদ্ধতার সংকট বড় ধরনের প্রকট সৃষ্টি হলে ২০১৫ সালে লন্ডন হতে ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেনকে এসে বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবীতে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন করে। যার নাম চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম। ঐ ফোরামের প্রতিষ্ঠা লগ্ন হতে ব্যারিস্টার মনোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান এবং মো. কামাল উদ্দিন মহাসচিবের দায়ীত্ব পালন করে আসছে। তারা দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে সামনে এনে জলাবদ্ধতা নিরসণের দাবীকে সরকার তথা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে আনতে সক্ষম হই।
এই জলবদ্ধতা নিরসনের জন্য কথা দিয়ে নিরসন করতে পারেনি এরশাদ সরকারের সময়ে মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, ৯১ এর বিএনপি সরকারের মেয়র মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, ৯৪ এর প্রথম নির্বাচিত মেয়র এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী দীর্ঘ ১৭ বছর মেয়রের দায়িত্ব পালন করেও জলাবদ্ধতার সংকট নিরসন করতে পারেনি। যার প্রেক্ষিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর ব্যর্থতাকে প্রাধান্যতা দিয়ে মঞ্জুরুল আলমকে মেয়র নির্বাচিত করেন নগরবাসী। কিন্তু মঞ্জুরুল আলমও চরমভাবে ব্যর্থ হন জলাবদ্ধতা সংকট নিরসনে। যার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে নগরবাসী নির্বাচিত করেন বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে। তিনিও অনেকাংশে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
এর মধ্যে জোরালো আন্দলনের রাস্তায় নামেন চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম। সেই ফোরামের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি ২০১৭ সালে জুনের ৯ তারিখ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মরকলিপি দিয়ে জলাবদ্ধাতা নিরসনের তাগিদসহ দশহাজার কোটি টাকা বরাদ্ধের আবেদন জানান। চট্টগ্রামবাসীর প্রতি সম্মান জানিয়ে চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরামের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলাবদ্ধাতা নিরসণে চট্টগ্রাম উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষের অনুকূলে পাঁচ হাজার ছয়শত ষোল কোটি টাকা ২০১৭ সালের ৯ জুলাই নাগরিক ফোরামের স্মারকলিপি প্রদানের ১ মাস পর এই বরাদ্ধ সমূহ প্রদান করেন। বরাদ্ধ পাওয়ার পর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধা নিরসনের পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরী হয় অপরিকল্পিত ভাবে নগরীর বিভিন্ন খাল নালাতে খোড়া খুড়ি করলেও কোন সুফল না পাওয়াতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার কোরকে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় কিন্তু তাদের কাছেও মাষ্টার প্ল্যান না থাকাতে কার্যক্রম শুরু করতে বিলম্বিত হয়। তার পরেও সেনা সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করে একটি প্ল্যান প্রণয়ন করেন। ঐ প্ল্যানের অনুকুলে জলাবদ্ধতার প্রকল্পের কাজ চলে আসলেও অনেকটা ধীর গতিতে অতিবাহীত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম নাগরিক ফোরাম প্রকল্প বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে মানববন্ধন সেমিনার কনভেনশনসহ একাধিক জনসচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি ঢাকা জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জলাবদ্ধতার প্রকল্প পরিকল্পিতভাবে তড়িৎ গতিতে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এর মধ্যে দেশের বৈর্ষিক মহামারী করোনার কারণে প্রকল্পের কাজ অনেকাংশে বন্ধ রয়েছে বলে জানা যায়।
একদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্প পুরো পুরি বাস্তবায়িত না হওয়া অন্যদিকে বর্ষার ভরা মৌসুম চলে আশাতে চট্টগ্রাম নগরবাসী সংকিত ও আতংকিত। করোনা ভাইরাসের কারণে নগরবাসী দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার পর লকডাউন প্রত্যাহার পূর্বক স্বাভাবিক কর্মজীবন ফিরে আসলেও করোনার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি দিন দিন প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি কর্মবিমূখ হয়ে পড়ছে। এর মধ্যে নগরী জলে মলে ডুবে গেলে স্বাভাবিক কর্মকান্ড স্থবিরতা বিরাজ করবে। ব্যবসা ও সাধারণ কর্মকান্ডে বেঘাত ঘটাসহ কমবেশী সবাই আর্থীক সংকটের মুখোমুখি হবে।