
সাঈদুর রহমান রিমন, ঢাকা অফিস:
স্বাস্থ্যখাতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক, মাফিয়া ডন খ্যাত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর লাগামহীন দৌরাত্ম্য থামছেই না। তার দুর্নীতি—জালিয়াতি ও হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের তদন্তও মুখ থুবরে পড়ে আছে দুদকে। গত প্রায় চার বছর ধরে তার বিষয়ে টু শব্দটিও করা হচ্ছে না, তদন্তের বিষয়াদিও চাপা পড়ে আছে। এমনকি দুদকের সুপারিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সর্বশেষ ঘোষিত ’কালো তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ি’ তালিকাতেও তার নাম দেয়া হয়নি। মিঠু সিন্ডিকেটের সহযোগী—শিষ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত ঘোষণা করেই দায় সেরেছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে চুনোপুটিদের কালো তালিকায় রেখে কার ছত্রছায়ায় বারবার বেঁচে যাচ্ছেন এই মিঠু— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে।
দুর্নীতি দমন কমিশন ২০১৬ সালে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে স্বাস্থ্যখাতের গডফাদার মিঠুর দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছিল। তদন্ত অনেকটা এগিয়েও ছিল। স্বাস্থ্যখাতে মিঠুর যাবতীয় কর্মকান্ড ও তার নামে বেনামে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য মহাপরিচালককে চিঠিও পাঠায় দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে মিঠুকেও তার সহায় সম্পদের বিবরণ দাখিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই রহস্যজনক কারণে সেই তদন্তের ধারাবাহিকতা থেমে গেছে। কিন্তু থামেনি মিঠু সিন্ডিকেটের লুটপাটের দৌরাত্ম্য। বরং প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তার সিন্ডিকেটের নতুন সদস্য হয়েছে, নিত্য নতুন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে তার। ফলে এখনও মিঠুর আঙ্গুলী হেলনেই চলছে স্বাস্থ্যখাতের যাবতীয় টেন্ডার, সরবরাহ ও কেনাকাটার কাজ। ২০১৬ সালে বিশ^ তোলপাড় করা পানামা পেপারস কেলেঙ্কারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারকারী হিসেবে যে ৩৪ বাংলাদেশির নাম এসেছিল, এই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুও তাদের একজন। এ কারণে মিঠুর ব্যাপারে দুদকের তথ্যানুসন্ধান ও তদন্তের বিষয়টি শুরুতে বেশ গুরুত্বও পায়।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নামে বেনামে থাকা ১৬ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য উঠে আসে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মিঠু ও তার স্ত্রীর যৌথ নামে রয়েছে লেংক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ ও টেকনোক্রেট লিমিটেড। মিঠুর স্ত্রী ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বড়ভাইয়ের নামে রয়েছে সিআর মার্চেন্ডাইজ ও এলআর এভিয়েশন নামে দুটি লাইসেন্স। মিঠুর ভাবীর নামে রয়েছে জিইএফ এন্ড ট্রেডিং। ভাগ্নের নামে রয়েছে ট্রেড হাউস। ভাগ্নেবধূর নামে রয়েছে মেহেরবা ইন্টারন্যাশনাল। আত্মীয়দের নামে আরো আছে— ক্রিয়েটিভ ট্রেড, ফিউচার ট্রেড, লেক্সিকোন আইটি প্রাইভেট লিঃ, টেকনো ট্রেড, বেলএয়ার এভিয়েশন, জিইএস এন্ড ট্রেডিং, হ্যাভ ইন্টারন্যাশনাল, লেসিকন হসপিটালিটি, নর্থ টেক এলএলসি লিমিটেড।
এছাড়া মিঠুকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটালের চেয়ারম্যান উল্লেখ করে সে বিষয়েও তথ্য চায় দুদক। দুদকের চিঠিতে মিঠুর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে— (১) বাসা নং—৮, রোড—৬, ব¬ক—সি, বনানী, ঢাকা। (২) কাজী ভবন, ৭ম তলা, ৩৯ নিউ এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা। (৩) রুম নং—৩০৯, রাজা রামমোহন মার্কেট, রংপুর (৪) হাউজ নং ৪২০, রোড—১১, সিডিএ, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম। (৫) ১৪৩, মালিবাগ বাজার রোড, ঢাকা। (৬) বাড়ি নং—৫/এ, রোড—২৫/এ, ব¬ক—এ, বনানী, ঢাকা। স্বাস্থ্যখাতে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ডের বিষয়ে তথ্য চেয়ে ২০১৬ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠায় দুদক।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও পরিচালককে লেখা দুদকের চিঠিতে ‘অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ ঠিকাদারী ব্যবসায় দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ’ বিষয়ে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নানা তথ্য চাওয়া হয়। চিঠিতে ২০০৮—২০০৯ অর্থ বছর থেকে এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেক্টরে বিভিন্ন উন্নয়ন, সেবা খাতে যে সমস্ত কাজ বাস্তবায়ন করেছে, চলমান আছে এবং ওষুধ—মালামাল—যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে সেগুলোর প্রশাসনিক অনুমোদন, বরাদ্দপত্র, প্রাক্কলন—টেন্ডার, কোটেশন, দাখিলকৃত টেন্ডার, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কার্যবিবরণী, কার্যাদেশ, কার্যসমাপ্তি প্রতিবেদনসহ প্রাসঙ্গিক সব রেকর্ডপত্র ২০১৬ সালের ৩০ মের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েক দফা তাগিদ দেয়ার পরেও স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এসব রেকর্ড আর দুদককে দেয়া হয়নি। দুদক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য উপাত্ত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট শাখার তৎকালীন লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক শামিউল ইসলামের কাছেও চিঠি দেয়। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী তথ্য—উপাত্ত সরবরাহ না করায় ওই বছরই দ্বিতীয় দফায় আবারও চিঠি দেয় সংস্থাটি। দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক স্বাক্ষরিত ওই চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই তদন্ত আর এগোয়নি। বরং চিঠি চালাচালির কৌশলবাজিতেই বিষয়টি ধামচাপা পড়ে আছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। পরবর্তীতে দুদকও আর মিঠুর বিষয় নিয়ে অজ্ঞাত কারণে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ফলে গত প্রায় চার বছর ধরে পাহাড়সম দুর্নীতি—লুটপাটের তদন্ত থেমে রয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে একক রাজত্ব তার
গত এক যুগ ধরেই স্বাস্থ্য খাতে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে মিঠু ও তার সিন্ডিকেট। স্বাস্থ্য খাতে অধিকাংশ দুর্নীতির সঙ্গে তার জড়িত থাকার অনেক প্রমাণ রয়েছে দুদকের কাছে। বিগত মহাজোট সরকারের শুরুতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে স্বাস্থ্য খাতে একচেটিয়া রাজত্ব করেন আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ওই সময় স্বাস্থ্য খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সঙ্গে এই সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। মিঠুর লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্র্যাট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার অসংখ্য ঘটনাও ঘটেছে। মহাজোট সরকারের শেষ বছরে কোনো কোনো হাসপাতালে একসঙ্গে তিন বছরের টেন্ডার করে রাখা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ফেলেন। কর্মকর্তাদের আর্শীবাদে পুরো স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবিভূর্ত হন মিঠু। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিনজন পরিচালকও মিঠু সিন্ডিকেটে যোগ দেন। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন। আর বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং তার ছেলের ওপর মিঠুর নিয়ন্ত্রণের কথাতো সিএমএসডির বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদ উল্লাহর চিঠিতেই উল্লেখ রয়েছে!
বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেট টানা বছরের পর বছর ধরে গোটা স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি—লুটপাটের শক্ত জাল বিস্তার করে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর বিশ্বস্ত এজেন্ট। এসব এজেন্টই মিঠুর হয়ে যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পাদন করে থাকে। কখনো উপরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব খাটানো হয়, কখনো অর্থের লেনদেনে ম্যানেজ করা হয়, আবার তাতে কাজ না হলে হুমকি—ধমকি দিয়ে কাজ আদায় করা হয়। মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার নামে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। প্রায় এক যুগ ধরেই টেন্ডারের নামে স্বাস্থ্যখাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে মিঠুর নেতৃত্বাধীন এই সিন্ডিকেট। কিন্তু দুদকের প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য প্রমান পেলেও এখন পর্যন্ত মিঠু ধরা—ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় ধরেই মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু স্বাস্থ্য খাতের অঘোষিত রাজা। স্বাস্থ্যখাতের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা রকম জাল—জালিয়াতির মাধ্যমে কার্যাদেশ নিয়ে অর্থ লোপাট তার পেশা বললেই চলে।
দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিকাদার মিঠু অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের কৌশলকে পুঁজি করে কয়েক বছরের ব্যবধানে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ঢাকার শ্যামলী রিং রোডে গড়ে তুলেন ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল। মিঠু নিজে এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। এছাড়াও রাজধানীর ধানমন্ডি, বনানী, ওল্ড ডিওএইচএস, গুলশান, মোহাম্মদপুরসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অভিজাত ফ্ল্যাট রয়েছে মিঠুর। রাজধানীতে নামে বেনামে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্লট। রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পূর্ব পাশে নির্মাণ করেছেন রাজকীয় বাসভবন। দেশের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্টে্রলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন। গড়ে তুলেছেন বিত্ত—বৈভব। মিঠুর গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচরার মহিপুর ইউনিয়নে। তিনি বেশিরভাগ সময় বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্যখাত। বিদেশেও রয়েছে মিঠুর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
মিঠুর উত্থান যেভাবে
মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। হাওয়া ভবনের দালাল ছিলেন মিঠু। ২০০১ সালে বিএনপি—জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসলে মিঠু সিন্ডিকেট আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এই বহুল আলোচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর হঠাত অস্বাভাবিক উত্থান ঘটে স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই। অনেক মন্ত্রী—সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত। মহাজোট সরকারের আমলে অর্থ—বিত্ত, প্রভাবে মিঠু রীতিমত ধরা ছেঁায়ার বাইরে চলে যান। এ সময় শীর্ষ মহলের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে একচেটিয়া লাগামহীন লুটপাট চালান তিনি। এমনকি কোনো কোনো হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই বিল তুলে নেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে নির্ধারিত যন্ত্রপাতির বদলে পুরাতন এবং নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, একই কাজের বিল একাধিকবার তুলে নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মোহাম্মদ নাসিম। মোহাম্মদ নাসিম মন্ত্রীপদে বসেই যে কোনো ধরনের সিন্ডিকেটকে এড়িয়ে চলার ঘোষণা দেন। এসময় তিন কোটি টাকা দামের গাড়ি উপহার দিতে গিয়েও ব্যর্থ হন তিনি। ফলে কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মিঠু সবকিছু আগের মতো ঠিকঠাক করে ফেলেন। মন্ত্রীর পরিবারের সদস্যকে সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে আবারো পুরো স্বাস্থ্যখাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হন। এসময় স্বাস্থ্যসচিব পদে ছিলেন নিয়াজউদ্দিন মিয়া। এরপর স্বাস্থ্যসচিব হয়ে আসেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। এই দুই সচিবও মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) পদে থাকাকালে ডা. এবিএম আবদুল হান্নান এবং তার পরের পরিচালক (হাসপাতাল) ড. সামিউল ইসলাম সাদীও মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) ডা. আব্দুর রশিদও এ সিন্ডিকেটের হয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন। সূত্রমতে, মন্ত্রী—সচিবসহ স্বাস্থ্যখাতের উপরের প্রশাসনিক পদগুলোতে যখন যিনি আসেন তিনিই মিঠুর সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে যান। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতের মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে।
মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তিন জন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য। এরা মিঠুকে শত শত কোটি টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন। তাদের একজন অবসরে চলে গেছেন। মিঠু সিন্ডিকেটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত আছেন একজন সহকারী সচিব। তিনি ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একই শাখায় পদ দখল করে রেখেছেন। আর মিঠুর কারণে এই কর্মকর্তার অন্য কোথাও বদলি করা যায় না। মন্ত্রণালয়ে মিঠুর হয়ে খুঁটিনাটি কাজগুলো সব দেখভাল করেন এই সহকারী সচিব। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতের নিচের পর্যায়ের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মিঠু সিন্ডিকেটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আবজাল দম্পত্তি ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ারও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। দুদকের অভিযানের মুখে আবজাল দম্পত্তির দেশে—বিদেশে বিদ্যমান সহায় সম্পদের বিবরণ শুনে অবাক হন গোটা দেশের মানুষ।
মাফিয়া মিঠুর দুর্নীতির সহযোগী শিষ্য খ্যাত হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক আবজালের সূত্র ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ইউনিটের ৪৭ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা—কর্মচারীর ব্যাপারেও তদন্ত চালায় দুদক। এদের মধ্যে প্রথম দফায় পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) ডা. আবদুর রশীদ, পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিসুর রহমান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেনকে দুদকে তলব করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ডাকা হয় আরো পাঁচ জনকে, তারা হলেন, ফরিদপুর টিবি হাসপাতালের ল্যাব এটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন, জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারের হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক রাকিবুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম ও খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। তারা সকলেই শীর্ষ মাফিয়া মিঠুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই সধিক পরিচিত।
মিঠু সিন্ডিকেটের প্রধান প্রধান সহযোগীর মধ্যে উপসচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত উপসচিব আবদুল মালেক, সুলতান মাহমুদ, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল কাফী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। খুলনাস্থ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের একজন উচ্চমান সহকারীও মিঠু সিন্ডিকেটের কল্যানে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই দেশ—বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে। একই সঙ্গে তারা নামে—বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে দুদকের তালিকায় থাকা ৪৭ কর্মকর্তা—কর্মচারীকে জরুরি ভিত্তিতে বদলি করার মধ্য দিয়েই অনিয়ম—দুর্নীতির সাজামুক্ত থেকে গেছেন তারা।