কোন কিছু জানাকে জ্ঞান বলে। আর জ্ঞানকে কাজে লাগানোর ক্ষমতাকে বলে দক্ষতা। দক্ষতা এবং জ্ঞান যে কোনও দেশের সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি। যে দেশের উন্নত মানের দক্ষতা রয়েছে তারা কাজের ক্ষেত্রে তত ভালোভাবে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর যুবসমাজ হল একটি সমাজের চালিকাশক্তি। যুব সমাজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সাহস, কর্মস্পৃহা ও কর্মক্ষমতা দেশ ও জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পৃথিবীর কাল পরিক্রমায় যুব সম্প্রদায়ই এনেছে পরিবর্তনের নতুন ধারা। তাই বিশিষ্টজনেরা যুবাদের মাঝেই খুঁজে পেয়েছেন অমিত সম্ভাবনার পথ। রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে যুব সম্প্রদায়কে সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে কাজে লাগানোর তাগিদ রয়েছে বোদ্ধামহলের।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের তথ্য প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যুব সম্প্রদায়কে অফুরন্ত সম্ভাবনার উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে যুবদের দক্ষতা উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা চাকরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষার্থীরা যে শিক্ষা পাচ্ছে, তাতে তারা চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, বিআইজিডি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এ জরিপটি চালায়।
সারা বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী চার হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণীর ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায় যে, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম্পিউটার ও ইংরেজি ভাষায় আত্মবিশ্বাসী মাত্র ১৬ শতাংশ। এছাড়া অংশগ্রহণকারীদের মাত্র এক-পঞ্চমাংশ মনে করেন যে, তাদের শিক্ষা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে দেখা গেছে, শুধুমাত্র চাকরি নয়, কেউ যদি উদ্যোক্তা হতে চান, তাহলে তারা ব্যবসা করার পুঁজি কোথা থেকে পাবে, এমনকি নিজেদের চাহিদাগুলোর ব্যাপারে বেশিরভাগ তরুণ সচেতন নয়।
গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের যুব সমাজ স্কুল কলেজে যে শিক্ষা পাচ্ছে, সেটা তাদেরকে কর্মজীবনের জন্য পরিপূর্ণরূপে তৈরি করতে পারছে না। কেননা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষতা শিক্ষার বড় ধরণের অভাব রয়েছে। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা যেই দক্ষতা অর্জন করছে সেই দক্ষতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত চাকরি নেই। আবার যে চাকরিগুলো রয়েছে, সেগুলোয় ভাল করার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন সেই দক্ষতা আমাদের যুব সমাজের নেই। যেমন কম্পিউটার পরিচালনায় দক্ষতা, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা অথবা কারিগরি যেকোন ধরণের প্রশিক্ষণ।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ১৪ শতাংশ তরুণ-তরুণী কারিগরি প্রশিক্ষণ পেয়েছে। আবার এই দক্ষতার মাপকাঠিতে দক্ষ তরুণের হার ২৪ শতাংশ অর্থাৎ তারা তাদের কম্পিউটারে দক্ষতার ব্যাপারে বেশ আত্মবিশ্বাসী। অথচ নারীদের কম্পিউটারে দক্ষতার হার মাত্র ১০ শতাংশ। অন্যদিকে ইংরেজিতে দক্ষতায় এগিয়ে ২১ শতাংশ তরুণ। যেখানে নারীদের এই ভাষাগত দক্ষতার হার মাত্র ১৪ শতাংশ, অর্থাৎ দক্ষতার দিক থেকে নারীরা এখনও অনেকটাই পিছিয়ে আছে। এই ব্যবধান শহরের চাইতে গ্রামে আরও বেশি চোখে পড়ে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, যেসব স্কুলে শিক্ষার মান উন্নত হয়, যেসব স্কুলে মানসম্মত পড়ালেখা হয়, সেখানে ভর্তি হওয়ার মতো সুযোগ বা সামর্থ্য গ্রাম অঞ্চলের অনেকের নেই। গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব তরুণ-তরুণীরা এখনও লেখাপড়া করছেন, তাদের মূল লক্ষ্য থাকে পড়াশোনা শেষে দেশের বাইরে যাওয়া। কারণ দেশে থেকে কিছু করার ব্যাপারে তারা একদমই আশাবাদী না।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে চান সবচেয়ে বেশি। আবার যারা ইংরেজি ভাষা এবং কম্পিউটারে বেশ দক্ষ, তারা যেতে চায় অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশে। এক্ষেত্রে সরকারের নেটওয়ার্কিং বাড়িয়ে এই শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করতে আরও দক্ষ করে তোলা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে দেশে প্রতি চারজন তরুণের একজন (২৭.৩৯%) কাজ, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত নেই। প্রতিবছর যে ২২ লক্ষ ছেলে-মেয়ে কর্মবাজারে যুক্ত হয় তাদের মধ্যে যুবাদের সংখ্যা বেশি এবং এদের বড় অংশেরই তেমন কোন দক্ষতা নেই। একই বছরে ৩৯ লক্ষ কর্মসৃজনের লক্ষ থাকলেও এর অর্ধেক (১৭ লক্ষ ৮০ হাজর) কর্ম সৃজিত হয়েছে। অথচ দেশের ৬০% জনগোষ্ঠী তরুণ এবং এদের তিন কোটি ২৪ লক্ষ কর্মবাজারের সবচেয়ে বড় শক্তি।
দেশের যুব সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ২০২১, ২০৩০ ও ২০৪০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার যথাক্রমে ২০, ৩০ ও ৪০ শতাংশে উন্নীত করবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এজন্য দেশে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তার আলোকে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনসহ নতুন নতুন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু খবরে হতাশার সুর রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কারিগরি শিক্ষায় বিরাজ করছে শুভংকরের ফাঁকি। কারিগরি শিক্ষার্থীর বর্তমান হার ১৪ শতাংশ বলা হলেও আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা অনুযায়ী বাস্তবে এটা ৮.৪৪ শতাংশ। কারণ এ শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে নানাবিধ সংকট। শ্রেণিকক্ষ, ল্যাবরেটরি ও শিক্ষকসংকট মারাত্মক। এক শিক্ষককে দিয়ে চালানো হচ্ছে দুই শিফট। এ নিয়ে শিক্ষকের মধ্যে ক্ষোভ বিদ্যমান। ফলে মানসম্পন্ন কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ কঠিন হয়ে উঠছে। অপরদিকে শ্রমবাজারের সঙ্গে অনেক কোর্স-কারিকুলামের কোনো সংগতি নেই। অর্থাৎ সিলেবাস এখনো যুগোপযোগী নয়।
আবার সরকারি হিসাবে কারিগরি শিক্ষায় দিন দিন মেয়েদের সংখ্যা কমছে। অথচ সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বর্তমানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। উচ্চ মাধ্যমিকে ছেলে-মেয়ে সমান সমান হওয়ার পথে। কারিগরিতে ২০১৩ সালে মেয়েদের হার ছিল ২৮.২৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২৭.৪৩ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২৩.৯৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২৩.৯৫ শতাংশ, ২০১৭ সালে ২৪.২৬ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ২৪.৭৬ শতাংশ।
দেশে সাধারণ সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। অন্যদিকে সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা মাত্র ৪৯। আর ৪৬১টি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থাকলেও ভালো মানের রয়েছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। ফলে বেশির ভাগ বেসরকারি পলিটেকনিকে আসন শূন্য থাকে।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকারের সাথে। তিনি বলেন, কারিগরি শিক্ষার উন্নতিকল্পে সর্বাগ্রে সরকারি কিংবা বেসরকারি ইনস্টিটিউটগুলোর অবকাঠামো ও জনবল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। সাধারণ স্কুল-মাদ্রাসার লাখ-লাখ শিক্ষার্থী যাতে যুগোপযোগী কারিগরি শিক্ষা লাভ করতে পারে, এজন্য কারিগরি ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স চালু করা প্রয়োজন। বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান হতে এসব প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীনভাবে দক্ষ জনবল নিয়োগ দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়া ছাড়া প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল বা কলেজকে কারিগরি কলেজে রূপান্তরিত করে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি ওয়ার্কশপ নির্মাণ করে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অন্তত একটি বিষয়ে স্কিল ট্রেনিং গ্রহণের মাধ্যমে অধিক হারে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে টিভিইটি গ্র্যাজুয়েটদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। তা ছাড়া কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা প্রয়োজন।
মো. মুশফিকুর রহমান (রিজভি)
বেকারত্বের প্রধানতম কারণ দক্ষতার অভাব
পূর্ববর্তী পোস্ট