
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই সবার মুখে মুখে একটি কথা ঢাকায় কী যেনো ঘটেছে। কেশবপুরের এমপি সুবোধ কুমার মিত্র ঢাকা ছেড়ে কোথায় যেনো হারিয়ে গেছেন। তালার এমপি সৈয়দ কামাল বখত সাকি ঢাকা থেকে বের হবার পর গ্রেফতার হয়েছেন। এমন বেশ কয়েকজন এমপিকে আটক করা হয়েছে। এসব কথা চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে আসলে কী ঘটেছে কেনো এবং কিভাবে এসব ঘটেছে তা নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষনও চলছে। খবর এলো বঙ্গবন্ধুকেও তারা গ্রেফতার করেছে। কোনটি সত্য কোনটি মিথ্যা তা নিয়ে ছিল দারুণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব। জনমনে শুধু আতংক আর উদ্বেগের চিহ্ণ। আমরা সঠিক কোনো খবরই পাচ্ছিলাম না। পাবো কি করে তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না। টেলিফোন ছিল সীমিত সংখ্যক। তাও আমজনতার কথা বলতে গেলে যেতে হতো এক্সচেঞ্জ পর্যন্ত। যাদের নিজস্ব টেলিফোন আছে তারাও যে সব কিছু জানতে পেরেছেন তাও কিন্তু নয়। দিনভর শুধু উত্তেজনা আর অপেক্ষা কি হলো না হলো তা নিয়ে। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কম।হাটে বাজারে লোকজন নেই। গাড়ি ঘোড়ার চলাচল স্থবির। স্কুল কলেজ থমথমে। মুখের স্বাভাবিক চেহারার হাসিটুকুও যেনো উবে গেছে। তখনও টেলিভিশন আসেনি গ্রামে গঞ্জে। আছে মাত্র কিছু সংখ্যক ফিলিপস রেডিও। ব্যাটারি লাগিয়ে অন করলে তাও ঘড়ঘড় কড়মড় করে। নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যদি বা বাংলাদেশ বেতার পাওয়া যায় তথাপিও সেখানে কৌতুহল মেটানোর তথ্য মেলে না। আর সে রেডিও স্টেশন তো সেনাদের দখলে। সকালে সেই রেডিও থেকে অনেকে শুনেছেন ঘাতকদের কথা ‘ শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে’। তবে এ কথা বহুজনের কানে কিন্তু দিনভর পৌছায়নি। আর যিনি এখবর পেয়েছেন তিনিও আতংকিত হয়ে তা চেপে রাখার চেষ্টা করেছেন।
তখনকার দিনে মানুষ বিশ^াস করতো বিবিসির খবর, ভয়েস অব আমেরিকার খবর। দুপুরে কোলকাতার খবর শুনতে সেকি উপচে পড়া ভিড় মানুষের। নির্দিষ্ট সময়ে ইথারে ভেসে এলো ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছে বাংলাদেশের বিপথগামী সেনারা। রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেছেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। কিছুক্ষণ পর দিল্লীর খবর ‘ আকাশবাণী , খবর পড়ছি ইলা মিত্র। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে একদল বিপথগামী সেনা সদস্য সপরিবারে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে’। গ্রেফতার করা হয়েছে বহু নেতাকে। দুপুর থেকে এসব খবর পেয়ে কৌতুহলী মানুষ অস্থির হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে সেনা সদস্যরা একথা বিশ^াসে আনতেই পারছিলেন না তারা। অবশেষে বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিশ^াস প্রতিস্থাপিত হলো সন্ধ্যায় বিবিসির খবরে । আর রাতে ভয়েস অব আমেরিকার খবরে। এ খবর নিয়ে সারারাত কাটলো সে যেনো এক বিভীষিকার অন্ধকারে। এরপরও বিস্তারিত খবরের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা মানুষ আরও বিস্তারিত খবরের সন্ধান করছিলেন। তাই ক্রোধ, বিষাদ, ঘৃণার রোষানলে আর সেই সাথে প্রতিশোধ মানসিকতায় তারা জ¦লে উঠছিলেন বারবার। এরপর অপেক্ষা খবরের কাগজের। সম্ভবতঃ একদিন পর গ্রামে পৌছালো দৈনিক পূর্বদেশ। পত্রিকাটির প্রধান শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা’। একটি ইংরাজী দৈনিকের খবর ‘ইধহমড়নধহফযঁ অংংধংংরহধঃবফ’ । আমাদের মুখ থেকে যেনো কোনো ভাষা আর বের হচ্ছিল না। শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল মানুষ। ভেতরে ভেতরে তারা জ¦লে উঠতে থাকলেন। কিন্তু ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারির পর পুলিশ ও মিলিটারিদের বুটের শব্দ তাদের আতংকিত করে তুলছিল বারবার।
এতো সবের পরও মানুষ বিশ^াস করতে চায়নি যে বঙ্গবন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে। তারা বিশ^াস করেছে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত , বঙ্গবন্ধু মরে নাই, যদি দেখা যেতো মিছিলে বঙ্গবন্ধু’। কিন্তু তাদের সে বিশ^াসকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রমানিত হলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে দিকভ্রষ্ট বিপথগামী ঘাতকের দল। জানা দরকার যে কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন ‘ আমি হিমালয় দেখিনি, আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি’। নিউজ উইক পত্রিকা বলেছিল ‘ পোয়েট অব পলিটিক্স’। ফিনানসিয়াল টাইমসএর মন্তব্য ‘মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনও জন্ম নিত না’। যে বঙ্গবন্ধুকে দেশ বিদেশের মানুষ এমনসব উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছে সেই বঙ্গবন্ধু তার নিজ মাটিতে তার দেশের মানুষের হাতে প্রাণ দেবেন এ বিশ^াস কেউ করতে পারেনি। তবু সত্য কথা এই যে ১৫ আগস্ট এর কালো রাতে জাতির পিতার বুকের রক্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচে গড়িয়ে গেছে। রক্তে ভিজে উঠেছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি।রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সুরক্ষিত বাসভবন ছেড়ে শুধুমাত্র আমজনতার মধ্যে থাকার ইচ্ছার কারণে বঙ্গবন্ধু বাস করতেন এই ৩২ নম্বরে। আর সেখানেই পৈশাচিক কায়দায় বন্দুক হাতে হামলা করলো একদল দিকভ্রান্ত সেনা সদস্য। তাদের বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় পুরো বাড়িটি। বয়ে যায় রক্তের বন্যা। এই বাড়িটিই ছিল বাঙ্গালির স্বাধিকার, বাঙ্গালির স্বাধীনতা, গনমুক্তির আন্দোলন সংগ্রামের তীর্থভূমি। সেখানেই সিঁড়িতে পড়ে রইলেন বাঙ্গালি মুক্তির মহানায়ক বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দিকভ্রান্ত ঘাতকরা বাংলার নরশার্দুলের নশ^র দেহকে ছিন্ন ভিন্ন নিশ্চিহ্ণ করলেও অবিনশ^র রয়েছে তার কীর্তি, তার জীবনজয়ী আন্দোলন , তার অর্জন , তার বজ্রকন্ঠ ভাষন, তার স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। মৃত্যুঞ্জয়ী বঙ্গবন্ধু তাই ‘মরে যাননি তিনি হৃদয়ের গভীরে রয়েছেন পরম যতনে’। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি স্বদেশের মাটি ও মানুষকে বেঁধেছিলেন হৃদয়ের বন্ধনে। সেই মাটি তাকে ছাড়েনি , সেই মানুষ তাকে ছাড়েনি। তার কীর্তি তার আদর্শ আর তার ভালবাসায় বাঙ্গালি গড়ে তুলেছে নতুন এক সৌধ। এই সৌধই বাঙ্গালির অতন্দ্র প্রহরী। বঙ্গবন্ধু বারবার বলে গেছেন ‘আমি সাতকোটি বাঙ্গালির ভালবাসার কাঙ্গাল, আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালবাসা হারাতে পারবো না’। তিনি বলেছিলেন ‘ওরা চিলির আলেন্দেকে হত্যা করেছে’। এর মধ্য দিয়ে তিনি আশংকা করেছিলেন কোনো বৈদেশিক শক্তি তাকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার পরোয়া করেন নি। তিনি বলেছিলেন বিশ^ আজ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।
বেদনাবিদুর ১৫ আগস্টের পর বাঙ্গালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবি লিখেছেন ‘কাঁদো বাঙ্গালি কাঁদো, যদি বাঙ্গালি হও নিঃশব্দে কাছে এসো, আরও কাছে, এখানেই শুয়ে আছেন অনন্ত আলোয় , নক্ষত্রলোকে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। কবি অন্নদাশংকর রায় বাংলাদেশকে বলেছেন ‘মুজিব ল্যান্ড’। অন্নদাশংকর রায় আরও লিখেছেন ‘ যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বারবার উচ্চারিত হয়েছে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি, বাংলাদেশ,আমার বাংলাদেশ, বিশ^কবির সোনার বাংলা নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা রূপের তো তার নাইকো শেষ’। সেই বাংলা রয়েছে লালসবুজ পতাকা নিয়ে । সেই বাংলা এখন বিশ^ দরবারে রয়েছে মাথা উঁচু করে। সেই বাংলায় পাখিরা মুক্ত আকাশের কোলে উড়ে বেড়ায়। সেই বাংলার মানুষ নিজেদের স্বাধীন বলে গর্ববোধ করে। সেই বাংলার মানুষ মুক্তির জন্য সাগর পরিমান রক্ত দিয়েছিল। সেই বাংলা নির্ভয়ে কথা বলছে মাতৃভাষা বাংলায়।অথচ সেই বাংলায় শুধু নেই শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতি বছর ঘুরে ফিরে আসে এই ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। এদিন সব হারানোর দিন। এদিন তবু জ¦লে ওঠার দিন। এদিন দ্রোহের দিন। শোকের আবহে এদিনকে শক্তিতে পরিণত করার দিন। এদিন নতুন প্রতিশ্রুতির দিন। এদিন বাঙ্গালির মুক্তপ্রাণে প্রতিধ্বনিত হোক ‘বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব’।