নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের ‘ইছানগর খাল’টি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে। দখলে খালটি নিখোঁজ হয়ে গেছে। খালের মাঝখানে টিন দিয়ে ঘিরে রেখে মাটি ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে একটি চিহ্নের শিল্পায়িত প্রতিষ্ঠান। সরকারি দপ্তরে নানা অভিযোগ ও প্রেসক্লাবে কয়েকটি পরিবেশবাদী ও সামাজিক সংগঠন এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে মানববন্ধন করলেও আমলে নিচ্ছে না প্রভাবশালী দখলদার ও সংশ্লিষ্টরা। ফলে, স্থাপনার নির্মাণকাজ এখনো চলছে। অন্যদিকে, প্রভাবশালী কতৃক ইছানগর খালটি ভরাট করার কারণে মাথায় বাজ পড়েছে। খালে চলাচলকারী শতাধিক সাম্পান মাঝি ও স্থানীয় জনসাধারণের। ইছানগরটি খালটি দিয়ে চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের প্রায় ২৫ হাজার মানুষের চলাচল ছিলো। অথচ তা জবর দখলের ফাঁদে পড়েছে। সাম্পান মাঝি মো. আলা উদ্দীন, আব্দুল মালেক, ইলিয়াছ, শফি আলম, মোঃ কবির ও মোহাম্মদ আবছার বলেন, ‘আমরা এ খাল দিয়ে ৩০/৪০ বছর ধরে নৌ-চলাচল করিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু বর্তমানে খালের জমি টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে এবং ভেতরে বিল্ডিং তৈরী করছে।’
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ইছানগর খাল দখল করে নির্মিত কারখানা সরিয়ে নিয়ে খালটি পুনঃরায় খনন করে দিতে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স, সি রিসোর্স কোম্পানি ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি—বেলা কর্তৃক উকিল নোটিশ দেয়ার দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে। অথচ খালের দখলকৃত অংশ উদ্ধারে কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।
কর্ণফুলী নদীর একমাত্র প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় হিসাবে খালটি যুগ যুগ ধরে ইছানগর বাংলাবাজার ও অভয়মিত্র ঘাটের সাম্পান মাঝিদের দূর্যোগে সাম্পান নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খালটি উদ্ধারে একাধিক বার মানববন্ধন করেছে স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, কর্ণফুলী নদীর শাখা ঐতিহ্যবাহী ইছানগর খাল আরএস ও বিএস সিটে চিহ্নিত জোয়ার ভাটার খাল। যা বিএফডিসি ও কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন অবৈধভাবে দখল ও ভরাট করে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করছে। যার কারণে খাল দিয়ে এখন আর মাঝিরা নৌকা চালাতে পারছে না।
দূর্যোগ ঘূর্ণিঝড়ে মাঝিরা খালটিকে পোতাশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করে। বৃহত্তর ইছানগর এলাকার পানি এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হতো। এছাড়া কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স তাদের বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলে পানি দূষণ করছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন, কর্ণফুলী নদী সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ফেডারেশন, ইছানগর সদরঘাট সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি ও ইছানগর বাংলাবাজার সাম্পান মাঝি কল্যাণ সমিতি নামের পাঁচটি সংগঠন মানববন্ধন করে খালটি উদ্ধারের দাবী জানানোর পর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার পক্ষ থেকে দখলকারীদের উকিল নোটিশ প্রদান করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ কবির স্বাক্ষরিত উক্ত নোটিশে বলা হয়, চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী থানাধীন ইছানগর খালটি ১নং খতিয়ানের বিএস ইছানগর মৌজার ১৫০৯,১৫১১,১৫১৪ ও ১১১৬ দাগাদির মধ্যে প্রবাহিত ছিল। কর্ণফুলী নদীর এই শাখা খালটি ইছানগর এলাকার পানি প্রবাহের একমাত্র অবলম্বন ছিল।
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা সাগর উত্তাল হলে উক্ত খালকে সাম্পান মাঝিরা বংশ পরম্পরায় পোতাশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করে আসছিল। কিন্তু উল্লেখিত তিন প্রতিষ্ঠান দেশের আইনের তোয়াক্কা না করে জোয়ার—ভাটার স্রোতধারা প্রবাহমান থাকা খালটি ভরাট করে সেখানে কারখানা ও ভবন তৈরি করেছে। যা দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
নোটিশে আরো উল্লেখ করা হয় বেলার প্রতিনিধির পরিদর্শনে দেখা যায়, কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স ১৫১৪ দাগের পুরো অংশ এবং ১৫১৩ দাগের অংশ দখল করে কারখানা তৈরি করেছে। সী রিসোর্স লি. ১৫১৩ দাগের ১৫ ফুট দখল করে কারখানা তৈরি করেছে। নোটিশে খালের ভরাট অংশ খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা দাবি জানানো হয়। সাত দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব না দিলে দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়।
অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নোটিশটি ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের সচিব, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে। উকিল নোটিশ দেয়ার দুই বছর অতিবাহীত হলেও এখনও খালটি উদ্ধারে দখলকারী বা স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন থেকে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এই বিষয়ে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ‘আমরা উকিল নোটিশ দিয়ে তাদের অবহিত করেছি। একটি খালকে মেরে ফেলা হয়েছে। অথচ স্থানীয় প্রশাসন কিছুই করলো না। আমরা নোটিশ দিয়ে জানানোর পরও তারা কিছুই করেনি। এখন আমরা এই বিষয়ে আদালতের দারস্থ হচ্ছি।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী (ডক) শীপইয়ার্ড লিমিটেড এর মুখপাত্র মোহাম্মদ সোলায়মান সর্বৈব অস্বীকার করে বলেন, ‘ আমরা কোন খালের উপর টিনের বেড়াঁ দিইনি। যারা আপনাদের বুঝিয়েছে ওটা সিক্রেট করে বুঝানো হয়েছে। ‘কর্ণফুলী সুরক্ষা পরিষদ’র সভাপতি কামাল পারভেজ বলেন, ‘ইছানগর খালটি হলো কর্ণফুলী নদীর প্রাণ, যদি খালটি না থাকে তাহলে ইতিহাস ঐতিহ্য যেমনটি হারাবে তেমনি মাঝি মাল্লাদের সাম্পানের ঘাট ছিলো বলে তা প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। প্রশাসনের নাকের ডগায় যে খালটি দখল হয়ে যাচ্ছে এবং প্রশাসনের নিরবতার কারণে একদিন এই প্রশাসনকে জনতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।’ খাল দখলের বিষয়িট স্বীকার করে কর্ণফুলী উপজেলার এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘খাল ভরাটের ঘটনাটি আমি যোগদান করার অনেক আগের। আরো আগেই ব্যবস্থা নেযা উচিত ছিল। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব, আইন ভেঙে যারা খাল ভরাট করেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এলাকার মানুষকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করার জন্য শাখা প্রশাখার খালগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রামে দখলে মৃতপ্রায় ইছানগর খাল: নিরব প্রশাসন
পূর্ববর্তী পোস্ট