সচ্চিদানন্দ দে সদয়: সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যে ঈশ্বরকে আমরা সব বিপদের মুক্তিদাতা ও সকল প্রেমের আধার বলে মনে করি, তিনি শ্রীকৃষ্ণ। সম্ভবত শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র, যাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী প্রতিটি মানুষ, নিজেদের ঘরের অন্দরে, আদর-যতনে রেখে পুত্র স্নেহে লালন-পালন করে। তাকে বড় করে তোলার প্রতিটি পর্ব, তার সঙ্গে নিয়ে যাপন করা প্রতিটি দিন; মাতৃ চেতনার প্রকাশ ঘটায় আমাদের মনে। কৃষ্ণ আমাদের ঘরে ঘরে মাতৃ জঠরে জন্ম নেওয়া সন্তান। তাই তাঁর জন্মদিন আমাদের পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের জন্মদিন পালনের মতোই আড়ম্বরপূর্ণ। হিন্দু পুরান মতে, ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টম তিথিতে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস পাশবিক শক্তি যখন ন্যায়নীতি, সত্য ও সুন্দরকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই শক্তিকে দমন করে মানবজাতির কল্যাণ এবং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল। বাংলায় জন্মাষ্টমীর উৎসব ভিন্ন স্থানে ভিন্ন নামে পরিচিত। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রের আবির্ভাব যখন প্রাধান্য পায়, তখনই আমরা পালন করি জন্মাষ্টমী। তাই জন্মাষ্টমীকে ‘অষ্টমী রোহিণী’ও বলা হয়। এর পাশাপাশি জন্মাষ্টমী পরিচিত কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী ও শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী হিসেবেও। শাস্ত্রীয় বিবরণ, জ্যোতিষী গণনা এবং লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, ৩২২৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দের ১৮ অথবা ২১ জুলাই মথুরা নগরীতে কংসের কারাগারে জন্ম নেন শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণের ভূমিষ্ঠ হওয়াকে কেন্দ্র করে, তার পূর্বের ও পরবর্তী সময়ের ইতিহাস এবং পৌরাণিক কাহিনীর কথা আমরা অনেকেই জানি। তাঁর সমগ্র জীবন জুড়ে যে যাতনা, লড়াই, বিপর্যয় ও একাগ্রতার পরিচয় আমরা পাই, তা আমাদের জীবনযাপনের প্রতিটি শূণ্য আধারকে পূর্ণ করে তোলে এবং জীবনদর্শনকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আর সে কারণেই আজ শ্রীকৃষ্ণের জনপ্রিয়তা বৃন্দাবন, মথুরা, গোকুল কিংবা দ্বারকার সীমারেখা পেরিয়ে বিশ্বের মুষ্টিমেয় দেশে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে উত্তর উত্তর। শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও কর্ম, সত্য সুন্দর ও ন্যায়ের পথে অবিনাশী অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তার মুখ নিসৃত বাণী শ্রীশ্রী গীতা বিশ্বমানবতার মুক্তি কর্ম-জ্ঞান ও বৈরাগ্যের সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয়। পার্থ সারথী শ্রীকৃষ্ণ সনাতন ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ। আজ তার জন্মতিথি। প্রতিটি হিন্দুগৃহে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্যদিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ভগবানের আবির্ভাবের ক্ষণটিও সর্বসুলক্ষণযুক্ত, ঐশ্বর্যমণ্ডিত তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লীলা সত্যিই অপূর্ব সুশোভামণ্ডিত, তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন, শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বসুদেব যশোদার গৃহে নিয়ে যান তখন ছিল ঝড়বৃষ্টি। অঝোর বারিধারার সিঞ্চন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচাতে অনন্তদেব এসে ফণা বিস্তার করে চক্রধারণ করেন। ভরা ভাদ্রের প্রমত্তা যমুনাও কৃষ্ণ গমনের পথ সুগম করে দেন। এসবই শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ।সনাতন ধর্মে শ্রীকৃষ্ণ সর্বব্যাপী। ধর্মে, অনুষ্ঠানে, আচারে, জীবন পরিচালনায় শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন জীবন অচল। এমন একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী পাওয়া যাবে না, যিনি শ্রীকৃষ্ণ অনুরাগী নন। শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর, মানুষের প্রয়োজনে দেহ ধারণ করেছেন। মানুষের মাঝে আদর্শ পুরুষের প্রতীকস্বরূপ তার জীবন বহুবার বিধৃত হয়েছে এবং এভাবেই অসুর নিধন করে মানবকুলকে রক্ষা করেছেন। অষ্টম গর্ভ অর্থ কি? অষ্টম অর্থ আমরা আটকে বুঝি। আট একটা সংখ্যা, এখানে আট সংখ্যাটা এসেছে আট প্রকার প্রকৃতি থেকে। সেগুলো হচ্ছে -আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল, মাটি, মন, বুদ্ধি, অহংকার এই আট প্রকার প্রকৃতি। আর গর্ভ= গ– র– ভ। গ- এসেছে গঠন থেকে অর্থাৎ গঠিত করা। র- এসেছে রত থেকে অর্থাৎ যুক্ত থাকা। ভ- এসেছে ভূ থেকে অর্থাৎ পৃথিবী। অষ্টম গর্ভের মূল অর্থ হচ্ছে যিনি এই আট প্রকার প্রকৃতি দ্বারা মহাবিশ্ব গঠনে যুক্ত ( রত) থাকেন। এই মহাবিশ্ব আট প্রকার প্রকৃতি দ্বারা গঠনে রত থাকেন? তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণ। তাই থাকে অষ্টম গর্ভ বলা হয়। শত্রুর কারাগারে জম্ম নেয়া, শিশুকাল হতে অসুরের বিরুদ্ধে নিরন্তর যুদ্ধ করা, সত্যধর্ম সংস্থাপনের পথ প্রদর্শক, সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জীবন দর্শন প্রদানকারী পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণর। বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উৎসব জন্মাষ্টমী। এ উৎসবে অংশ নিতেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। শুধু তাই নয়, একসময় ঢাকা শহরে জন্মাষ্টমীর যে শোভাযাত্রা বের হতো তা সারা উপমহাদেশে ছিল খ্যাত। শ্রাবণ বা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম তিথিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এক পুণ্যের দিন। এদিন শ্রীকৃষ্ণ পাপ দমন ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য দেবকী বাসুদেবের পুত্ররূপে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। সে তো আগেই উল্লেখ করেছি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করে, এ দিনে শুধু উপাবাসেও সাত জন্মের পাপ মোচন হয়। আর তাই এ দিনটিতে তারা উপবাস করে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন। এর সঙ্গে সঙ্গে কালের স্রোতে ধীরে ধীরে যুক্ত হয় র্যালি বা শোভাযাত্রা। ক্রমেই জন্মাষ্টমী পালনের প্রধান অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় এ শোভাযাত্রা।জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পঞ্চামৃত নিবেদন করা হয় এবং পূজার শেষে ভক্তদের মধ্যে তা প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। পঞ্চামৃত শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি সেবন করলে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিভিন্ন উপকারও পাওয়া যায় পঞ্চামৃত শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে; ‘পঞ্চ’ অর্থ ‘পাঁচ’, এবং ‘অমৃত’ অর্থ ‘ঈশ্বরের অমৃত’ (বা অমরত্ব পাওয়ার পৌরাণিক পানীয়)। এটি ঐতিহ্যগতভাবে পূজায় ব্যবহৃত হয় কারণ এটি অত্যন্ত পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। পঞ্চামৃত দেবতার পূজার অভিষেকের সময়ও ব্যবহৃত হয়।মহাভারত অনুসারে, পঞ্চামৃত সমুদ্র মন্থনের সময় উদ্ভূত উপাদানগুলির মধ্যে একটি, তাই সমুদ্র মন্থন “ক্ষীরা সাগর মন্থন” (দুধের সমুদ্র মন্থন) নামেও পরিচিত। দুধ, মধু, দই, চিনি ও ঘি এই পাঁচটি উপাদানের মিশ্রণকে বলা হয় পঞ্চামৃত বা দেবতার পানীয়।ঘোর অমানিশার ভেতর দিয়ে যে ঈশ্বর জন্মেছেন, তাঁর গায়ের রং নিয়ে আমাদের অনেকেরই নানা বিতর্কিত মতামত আছে। তবে শ্যাম অর্থে শ্যামলাভ যদি বোঝানো হয়, তবে তা ধূসর, পীত, কালো আর নীলের ঘনসন্নাবস্থান। তবু, কোথাও তাঁকে দেখা যায় কুচকুচে কালচে দেহে বাঁশি হাতে, কোথাও আবার ঘন নীলের মহিমায়। অন্যায়, অসত্য ও পাপের দ্বারা পরিচালিত ও প্ররোচিত হয়ে জ্ঞান শূন্যতার অহমিকায় ভুগছি আমরা। আত্নঅহংকারে ভুলে যাচ্ছি মহান সৃষ্টিকর্তাকে। পার্থিব সুখে ভুলে যাই মহা অবতার ভগবানের সঙ্গে আমাদের চিন্ময় সম্পর্ককে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মাধ্যমে পবিত্র শ্রীমদভগবত গীতায় যে জ্ঞান দান করেছেন তাও যদি আমরা গ্রহণ করতে সক্ষম হতাম এবং যথাযথভাবে পালন করতাম তবে কোনো প্রকার অন্যায় ও অসত্য আমাদের ঈশ্বর চেতনাকে স্পটতাই জন্মাষ্টমী শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আজও যেমন বেঁচে আছে বাংলার স্থাপত্য, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি, তেমনই যুগিয়ে চলেছে বহু মানুষের অন্নসংস্থানও। মহাবতার পরম চেতনার অধিকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনি:সৃত গীতার জ্ঞান যুগ যুগ ধরে মানবজীবনের পথ চলায় আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। এই জ্ঞানের আলোকিত জগতে নেই কোনো শঠতা, অন্যায় আর অসত্যের স্থান। ঠাঁই নেই কোনো অপশক্তির। বরং প্রতিনিয়ত সব রকমের ভীরুতা দূর করে অন্যায়কে প্রতিহত করার শিক্ষা পবিত্র গীতা আমাদেরকে দান করেছে। পাপাচারে আচ্ছন্ন পরিবেশের বহি:শক্তি ও অন্ত:শত্রুর হাত থেকে জীবসত্ত্বাকে রক্ষা করে ভগবানের আনন্দ বিধানের জন্য করণীয় সম্পর্কে জ্ঞান ও উপদেশ গীতার মাধ্যমেই আমরা পেতে পারি। এই বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বীদের।
লেখক: সভাপতি, বুধহাটা দ্বাদশ শিবকালী মন্দির ও সাংবাদিক
জন্মাষ্টমী, শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ
পূর্ববর্তী পোস্ট