
আমাদের উদীচী ও সত্যেন সেন শেখ সিদ্দিকুর রহমান
অবিভক্ত বাংলা সাহিত্যের প্রগতিবাদী লেখক হিসেবে এবং এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগামী নেতা হিসেবে পরিচিত নাম সত্যেন সেন। সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার এ দেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দীর্ঘকালের সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে।
ঢাকার বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ জেলা) সোনাররং গ্রামের সোনালি মনের মানুষ সত্যেন সেনের পিতার নাম ধরণীমোহন সেন এবং মাতার নাম মৃণালিনী সেন। সত্যেন সেনের প্রকৃত নাম ছিল সতেন্দ্র মোহন সেন (লস্কর) যা সংক্ষেপে সত্যেন সেন নামে অভিহিত। জন্ম তার ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ এবং ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি মতান্তরে ০৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮১ তিনি শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।। প্রায় চুুয়াত্তর বছরের সুদীর্ঘ জীবনে প্রায় ২১ বছর ব্রিটিশ ও পাকিস্থানি শাসকদের কারাগারে কাটান। তিনি একাধারে ছিলেন গীতিকার,গায়ক,শিল্পী সাহিত্যিক,সাংবাদিক, রাজনীতিক, সংগঠক ও বিপ্লবী। শ্রদ্ধেয় রণেশ দাশগুপ্ত তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ” বিপ্লবী নয়া ধ্রæপদী গণ-কথাশিল্পী সত্যেন সেন। তার অনেক ভাল কাজের মধ্যে একটি হলো ১৯৬৮ সালে জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে গণনাট্য ও গণসংগীতের সহায়তায় বাংলাদেশের গণ-অভ্যুদ্বয়কে অনুপ্রানিত,অনুরণিত এবং শানিত করার জন্য ঐ বছরের ২৯ অক্টোবর ” বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। যে সংগঠনটি আজ ৫১ বছরে পর্দাপণ করেছে। বর্তমানে এ সংগঠন বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩০ টির বেশি দেশে কার্যকরী শাখা বিস্তার করেছে।
সত্যেন সেন পরিণত বয়সে লেখালেখি শুরু করেন। তিনি ছিলেন বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তান । এ ছাড়া তিনি ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট আত্মীয়। জীবনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার পূর্ণতা সত্তে¡ও যৌবনকালে সাহিত্যেও কোনদিকে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। পঞ্চাশের দশকে যখন জেল জুলুম,অত্যাচারের ফলে গণ-আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লো এবং তাকে বারবার কারাবন্দি হতে হলো তখন সেই স্তব্ধপ্রায় আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে তিনি কারাগারের মধ্যে থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকে বেশি জোর দেন। তিনি কেবলই সাহিত্যিকের খাতায় নাম লেখানোর জন্য সাহিত্য রচনা করেননি। সংগ্রামী জীবনের দায়িত্ব পালনের জন্য মেহনতি মানুষের সংগ্রামও সমাজ প্রগতির সংগ্রামকে শাণিত করে তোলার জন্য সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত হয়েছিলেন।
তার সাহিত্যের মুখ্য বিবেচনা মেহনতি মানুষ ও তাদের বেচে থাকার সংগ্রাম। মেহনতি মানুষের সুখ-দুঃখ,আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, টাওয়া-পাওয়া আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সত্যেন সেনের সাহিত্যেও মূল প্রতিপাদ্য। তার লেখায় নি¤œবর্ণের মানুষের জীবন অন্বেষণ ও সমাজ সভ্যতার বিচিত্র চিত্র রুপায়িত হয়েছে। এ বিষয়ে তার উপন্যাসগুলি ” রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ”’ সেয়ানা” ’পদচিহ্ন” ” একুল ভাঙে ওকুল গড়ে” প্রভৃতি।
তিনি ১৯৫৮ হতে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জেলে থাকা অবস্থায় যে উপন্যাসটি লিখেছিলেন তা হলো, রুদ্ধদ্বার মুক্তপ্রাণ,। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৬টি।
সত্যেন সেন প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে সমাজের তলদেশ অবধি সঞ্চারিত করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। তাই তিনি সংস্কৃতির সঙ্গে জীবনকে যুক্ত করার বিপুল কর্মকান্ডেরও আয়োজন করে গেছেন। আর তাই তাকে চিনতে হলে একমাত্র উপায় হচ্ছে তার গান। তিনি বহু গান রচনা করে গেছেন। সত্যেন সেন নিজে সুকন্ঠের অধিকারি ছিলেন।
সাতক্ষীরার মানুষের উদীচী সর্ম্পকে ধারনা খুবই কম। উদীচী মানেই নাচ-গান ও আনন্দ মনে করেন অনেকেইে। কিন্তু সত্যেন সেন,রণেশ দাশগুপ্ত ও উদীচী সর্ম্পকিত দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের লেখা বই পড়লে সংগঠনটির কর্মকান্ড বিষয়ে ধারনা পাওয়া যাবে। আশির দশকে সাতক্ষীরাতে উদীচীর আবির্ভাব ঘটলেও তা বেশিদিন স্থায়িত্ব পাইনি। গত ২০১১ সালের ১২ মার্চ সাতক্ষীরাতে উদীচীর প্রথম জেলা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এ সংগঠনটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ১৩ জুলাই,২০১৯ অনুষ্ঠিত হচ্ছে পঞ্চম দ্বি-বার্ষিক জেলা সম্মেলন। বলতে দ্বিধা নেই ঢাকা, খুলনা,যশোর,ঝিনাইদহ, মাগুরা, ও কুষ্টিয়াতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সম্মেলন ও বিভাগীয় কমিটির সভা ও সাংগঠনিক সভাতে আমি উপস্থিত থেকেছি একাধিকবার, এছাড়া আমাদের সাতক্ষীরা উদীচীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার, অধ্যাপক নিমাই মন্ডল, রমজান আলি, স্বপন মন্ডলসহ আমরা যারা ঐসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে উদীচীর কর্মকান্ড দেখেছি ,শুনেছি তারাই কিছুটা হয়তো ধারনা পেয়েছি। উদীচী সর্ম্পকে ধারনা রাখেন আরও একজন, তিনি হলেন সাংবাদিক ও অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম। উদীচীর অনেক বই তিনি পড়েছেন। এছাড়া আরও একজন ছিলেন তিনি প্রয়াত মুফতি আব্দুর রহিম কচি। গত ২৯ অক্টোবর সাতক্ষীরা জেলা সংসদের আয়োজনে উদযাপিত হয়ে গেল উদীচীর ৫৩ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী । অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজ, সুজনের জেলা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার, আশাশুনি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাংবাদিক অসিম চক্রবর্তী। আলোচক ছিলেন জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক সাংবাদিক আনিসুর রহিম।
সাতক্ষীরাাতে উদীচীর পথচলা থেমে নেই। আমরা চেষ্টা করছি এ চলা অব্যাহত রাখতে । গত ০৮ জুলাই সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে প্রথম একটি শাখা সংসদের গোড়া পত্তন করেছি । আগামীতে আরও শাখা ও কর্মী বাহিনী তৈরি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। আমরা চাই নের্তৃত্ব নয় কর্মী হয়ে কাজ করতে । জয় উদীচী।