তিনি নিজে ভাবেন, মানুষকে ভাবান। নিজে চিন্তা করেন, চিন্তা দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করেন। পৃথিবীর প্রভাবশালী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান তার ভাবনা-চিন্তা ধার করে মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। ভারতের টাটা, ফ্রান্সের ড্যানোন, ভিয়োলিয়া ওয়াটার, জার্মানির বিএএসএফ, জাপানের ইউনিক্লোর মতো পৃথিবীবিখ্যাত প্রতিষ্ঠান তার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে ‘সামাজিক ব্যবসা’ শুরু করেছে। কলম্বিয়ার কফি উৎপাদন ব্যাহত হয়ে মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, গভর্নর তখন ছুটে আসেন তার কাছে। সামাজিক ব্যবসা আবার হাসি ফোটায় কফি চাষিদের মুখে।
বলছি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা। তার গড়ে তোলা গ্রামীণ ব্যাংক পৃথিবীব্যাপী বিস্তৃত। ১৯৭৪ সালে নিজের পকেটের অর্থ দিয়ে যে ক্ষুদ্রঋণ ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন, সেটাই মহিরুহ রূপে গ্রামীণ ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ড. ইউনূসের সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকও পেয়েছে নোবেল পুরস্কারের সম্মান।
পৃথিবীর ৪২টি দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের মডেলে ১৩২টি প্রতিষ্ঠান সফলভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ থেকে শুরু করে গরিব দেশেও তার কার্যক্রম বিস্তৃত। আমেরিকা, ইউরোপ, ভারতসহ পৃথিবীর ৩৩টি দেশের ৮৩টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস চেয়ার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বউদ্যোগে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সেখানে গবেষণা হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কর্ম ও জীবনাদর্শ নিয়ে। সামাজিক ব্যবসার ওপর কোর্স চালু হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে। পৃথিবীর মাত্র সাত জন ব্যক্তির একজন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যিনি পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম ও কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেলসহ বহু পুরস্কার। বাংলাদেশকে তিনি এনে দিয়েছেন এসব বিরল সম্মাননা।
প্রখ্যাত এই মানুষটির জন্ম ১৯৪০ সালের ২৮ জুন। আজ তার জন্মদিন, ৮০তম জন্মদিন। জন্মদিন অন্যরা পালন করতে চান, কিন্তু, তিনি নিজে চান না। ফলে দিনটি পালিত হয় ‘সামাজিক ব্যবসা দিবস’ হিসেবে। সামাজিক ব্যবসা দিবস পালিত হয় তিন দিনব্যাপী। কোনো বছর মেক্সিকো, কোনো বছর প্যারিস বা ব্যাঙ্গালুরু বা ব্যাংককে পালিত হয় সামাজিক ব্যবসা দিবস। সারা পৃথিবীর ৫০টিরও অধিক দেশ থেকে এক থেকে দেড় হাজার ডলার ফি দিয়ে দুই থেকে আড়াই হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়ে থাকেন এ আয়োজনে। এবারের করোনা মহামারিকালে দিবসটি পালিত হচ্ছে জার্মানির মিউনিখে। ইউরোপের প্রতিনিধিরা মিউনিখে এসেছেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিরা ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হচ্ছেন। ঢাকা থেকেই দিবসের মূল বক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কথা বলেছেন। এবারের সামাজিক ব্যবসা দিবসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবনা-চিন্তা দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের জন্য।
নতুন পথের সন্ধানে
করোনাভাইরাস মহামারি একটা বিরাট আঘাত। পুরো পৃথিবীতে এটা বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং কুপোকাত করে ফেলেছে। এটা কল্পনাতীত একটি বিষয়। মানুষের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। অনেককে নিজের জীবন পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। আবার অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় বেঁচে আছেন। এর মধ্যেও কিছু আশার আলো রয়েছে।
করোনাভাইরাস আমাদের সামনে একটি বিরাট সুযোগ এনে দিয়েছে। সেটা পরিবর্তনের সুযোগ। আমাদের মনে এখন প্রশ্ন জাগে, আবার কবে আগের মতো স্বাভাবিক হব। সেই সময়ের মতো আমরা স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে চাই, ফিরে যেতে চাই সেই আগের জায়গায়। তবে, আমার প্রশ্ন হচ্ছে— কেন আমরা সেই জায়গায় ফিরে যেতে চাচ্ছি?
আমাদের যাত্রাটিতো আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল ধ্বংসের দিকে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে পৃথিবী প্রায় ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গেছে। আমাদেরকে সাবধানতার বাণী শোনানো হচ্ছিল। আর কয়েকবছর এভাবে চললেই সব শেষ হয়ে যাবে। করার আর কিছু থাকবে না। গণনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীতে মানবজাতিসহ সকল প্রাণীর বিলুপ্তি ছাড়া আর কোনো গতি ছিল না। সেই আগের পরিস্থিতিতে ফিরে বিলুপ্তির সেই একই পথে আবার হাঁটার কোনো কারণ দেখি না। আমরা বরং করোনাকে ধন্যবাদ দেবো এই চিন্তা থেকে— ধ্বংসের পথে আমরা যে গতিতে এগোচ্ছিলাম, সেখানে বাধা তৈরি করে গতি কমিয়ে আমাদের রক্ষা করেছে এটি।
আমার মনে হয় আমরা আর আগের সেই পথে ফিরে যেতে চাই না— সেই সিদ্ধান্তটি আমাদের নিয়ে নিতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তখন নতুন পথ তৈরি হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি তৈরি করা মৃত্যুর পথে যাব? নাকি অজানা নতুন পথ সন্ধান করে জীবনের পথ খুঁজব? আমার মত থাকবে— জীবনের পথে যাওয়ার। নতুন করে পথ গড়ে জীবনের পথে যেতে হলে কিছু বিষয় আমাদের পরিহার করতে হবে। আর কিছু বিষয় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। এখনই সময় সেই তালিকাটি তৈরি করে নেওয়ার।
প্লাস্টিক, ফসিল ফুয়েলের মতো যেসব জিনিস বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়িয়ে আমাদের মৃত্যুর পথে নিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো নতুন পৃথিবীতে আর চাই না। নতুন পৃথিবীর কাজ শুরু করতে চাই গ্রিন এনার্জি দিয়ে। এতে জীবনের গতি কমে গেলেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে। দ্রুত গতিতে মৃত্যুর পথ, নাকি ধীর গতিতে জীবনের পথ— যে কোনো একটি আমাদের বেছে নিতে হবে। সম্পদের যে কেন্দ্রীভূতকরণ, তা থেকে আমরা রেহাই পেয়ে যাব। জীবনের পথে গেলে এই সম্পদ থাকবে সবার হাতে, গুটিকয়েক মানুষের হাতে না। সেই পৃথিবী আমরা গড়তে চাই। যে পথ আমাদের বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, সেই পথে আর যেতে চাই না।
পৃথিবীর পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেই যাচ্ছেন, ২০৪০ সালের মধ্যেই আমরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির সহনীয় মাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমায় পৌঁছে যাব। এই সীমাকে যদি বাড়িয়ে সহনীয় মাত্রায় নেওয়া সম্ভব হয়, তবে তা হবে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যাবে। তারপর পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে থাকবে। মানবজাতির বিলুপ্তি, পৃথিবী ধ্বংস তো অনিবার্য হয়ে উঠবে। এটা তো বিজ্ঞানের কথা। বিজ্ঞানীরা তো একথা বলে আমাদের সতর্ক করছেন। শুনছি না। উষ্ণতা বাড়িয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। করোনাভাইরাস আমাদের ধ্বংসের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত করেছে। এখন আমরা যদি বাঁচতে চাই, পৃথিবীকে যদি বাঁচাতে চাই, তাহলে প্রয়োজন নতুন পথের সন্ধান। সেই পথের সন্ধান পাওয়া মানবজাতির পক্ষে অসম্ভব নয়। আমাদের কোথায় যেতে হবে তা জানা আছে। কীভাবে যেতে হবে, তারও কিছু কিছু জানা আছে। এখন শুধু সেগুলোর বাস্তব ব্যবহার করতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়, নিজেদের পৃথিবী নিজেরাই গড়ব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তবে, আমরা মানুষ, আমরা নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে নিজেদের পৃথিবী গড়ে তুলব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে পৃথিবীকে ছেড়ে দিয়ে আমরা অবসর নিতে চাই না।
প্রযুক্তি মানুষের মঙ্গলের জন্যও হয়, মানুষের ধ্বংসের জন্যও হয়। পারমাণবিক অস্ত্রও তো প্রযুক্তি। তাই বলে সেটাকে তো আর মানুষের জন্য আশীর্বাদ বলা যাবে না। কাজেই প্রযুক্তি হলেই তা আমরা লুফে নেব, তাতো না। দেখতে হবে প্রযুক্তিটি মানুষের জন্য কল্যাণকর, নাকি মানুষের ধ্বংস ডেকে আনবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মানুষকে বাদ দিয়ে যন্ত্রের অংশগ্রহণ করানো হচ্ছে। মানুষ যত কাজে নিয়োজিত আছে, তার সব জায়গাতেই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলে আসবে। এতে করে মানুষ কর্মচ্যুত হবে, মানুষের অমঙ্গল হবে। সকল মানুষের কাজ যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে চলে, তাহলে মানুষের রোজগারের আর কোনো পথ থাকবে না। মানুষের সব কাজ যদি যন্ত্র নিয়ে নেয়, মানুষের আর কোনো মূল্য থাকবে না। তাকে বাঁচতে হবে ভিক্ষুকের মতো।
আমরা যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াচ্ছি তো ব্যবসায়ীদের জন্য। এর মাধ্যমে তাদের উৎপাদন ব্যয় কমবে এবং মুনাফা বাড়বে।
আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা প্রযুক্তির বিপক্ষে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের অমঙ্গলে ব্যবহারের বিপক্ষে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি চিকিৎসা বা শিক্ষার কাজে লাগে, তাহলে তাতো হবে মঙ্গলের জন্য। এমন আরও অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে মানুষের উপকার করা সম্ভব। কিন্তু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এই প্রযুক্তি তো বিত্তবান ব্যবসায়ীদের হাতে। তারা মনে করতে পারে, মানুষকে দিয়ে কাজ করানো অনেক যন্ত্রণার। তাকে বেতন দিতে হয়, ইনক্রিমেন্ট দিতে হয়। তার আরও দাবি-দাওয়া থাকে। পূরণ না করলে নানা যন্ত্রণা। সেই তুলনায় যন্ত্র দিয়ে কাজ করানো অনেক স্বস্তিদায়ক। এটা ভেবে নিয়ে তারা যদি যন্ত্রের দিকে এগিয়ে যায়, মানুষের তো আর কিছু করার থাকবে না। পৃথিবীর সম্পদ আরও বেশি কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে। কয়েকজন মানুষের হাতে পৃথিবীর সম্পদ, তা আরও বাড়বে।
জন্ম যেখানে রিজিকও সেখানে
বাংলাদেশের প্রায় এক কোটিরও বেশি মানুষ প্রবাসে আছেন। তাদের জন্য হতাশার একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। তারা বিদেশ থেকে ফিরে আসছে। তাদের চাকরির সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চয়ও শেষ হয়েছে। গ্রামের গরিব মানুষরা কাজের জন্য শহরে এসে পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় কাজ নিচ্ছে। কোনো বিপদ হলে আবার ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। গ্রামে গেলেই আবার তাদের কাজ নেই।
এর কারণ হচ্ছে— আমরা এটা ভাবিনি, মানুষ যে যেখানে আছে সেখানে থেকে কীভাবে আয়-রোজগার করবে। আমরা ভেবেছি, কীভাবে কলকারখানা হবে এবং সেখানে মানুষ কাজ করবে। কলকারখানার মালিকদের লাভের হিসাব করেই শহরে কলকারখানা গড়ে তুলেছি এবং গ্রামকে এমনভাবে তৈরি করেছি যে তারা শুধুই শ্রম সরবরাহ করবে। গ্রামগুলো মূলত শ্রমিক তৈরির কারখানা। এই যে কাজের আশায় দূরে যাওয়া এবং কাজ শেষ হলেই বা চাকরি হারালেই আবার ফিরে শেকড়ের কাছে চলে আসা, এই কাঠামোতেই সমস্যা আছে। যে যেখানে আছে সেখানেই তার জন্য অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া, আর কোনো উপায় নেই। শহরে যে শিল্প কারখানাগুলো চলে, তার শ্রমিক এবং কাঁচামাল আসে গ্রাম থেকে। শহরে এনে সেগুলো প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। এত কষ্ট কেন? কেন আমি গ্রামেই এসব প্রক্রিয়াজাত করছি না?
আগে বলা হতো অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে গ্রামে কলকারখানা করা সম্ভব না। এখন তো আর তা নেই। সকল ধরনের অবকাঠামো ও যোগাযোগের সুবিধা এখন গ্রামেও পাওয়া যায়। কারখানাগুলো গ্রামেও তো করা যায়। এক জায়গাতেই সবগুলো কারখানা করতে হবে তার কোনো মানে নেই। বিদেশি ক্রেতারা যদি দেশে আসতে চায় তো তারা শহরে এসে কথা বলে যাবে। গ্রামের কারখানা দেখতে চাইলে যাবে। তাতে অসুবিধাটা কী?
আমার কথা হলো— যার যেখানে জন্ম, তার রিজিকও সেখানে হতে হবে। এখন এটা সম্ভব। আগের সেই দিন এখন আর নেই। এখন গ্রামকে শহরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামাতে হবে। সমান্তরালভাবে উভয় স্থানেই সমান উন্নয়ন করে যেতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও শহরে করা হচ্ছে। গ্রামের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় করা যায় না? একটা গ্রামের ছেলে গ্রামেই পড়াশোনা করে গ্রামেই কাজ করবে। তার শহরে আসার তো কোনো কারণ নেই।
পৃথিবীজুড়ে করোনা সংকট হওয়ায় আমরা এই সব দেখতে পাচ্ছি। এখন আমাদের চোখে পড়েছে যে মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।
ঈদে যখন মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে, তখন তারা আনন্দ করতেই গিয়েছিল। কিন্তু, তারা হুট করে শহরে ফিরতে বাধ্য হয়েছিল কারণ তাদের কারখানা খুলে গিয়েছিল। তারা বাধ্য হয়েছিল আসতে কারণ না আসলে তাদের চাকরি থাকবে না। এসব হিসাব করেই আমাদের পরবর্তী সময়ের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
কেউ চাইলেই একটা পোশাক কারখানা গ্রামের মধ্যে করতে পারে। সেখানে শ্রমিকরা বাড়ির ভাত খেয়ে, বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করে কাজ করবে। সেটাই হলো কারখানা। ব্যবসায়ীদের ভাবতে হবে, আমি শুধু মুনাফা করতে আসিনি, আমাকে মানুষের সেবাও করতে হবে। এই কাজটি ব্যবসায়ীরা করবে না। কারণ, তাদের মুনাফা দরকার। একমাত্র সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের প্রকৃত সমস্যার সমাধান সম্ভব।
করোনার ভ্যাকসিনের জন্য আপিল
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কাজ করছে। অবশ্য সবাই সফল হবে না। হয়তো ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানের হাতে ভ্যাকসিন থাকবে, তার মধ্যে ভালো-মন্দ থাকবে। যারা এসব উৎপাদন করছে তারা তাদের ব্যবসায়িক চিন্তা এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠান তাদের করোনার ভ্যাকসিন সবার আগে আমেরিকায় বিক্রি করবে বলে জানিয়েছে। কারণ, তারা বেশি মূল্য দিতে চেয়েছে। ফ্রান্সের সানোফির মতো বড় প্রতিষ্ঠান এই পরিকল্পনা করে রেখেছে। আমেরিকার চাহিদা শেষ হলে তারপর তারা অন্য কোনো দেশে দেবে।
আরেকটি প্রতিষ্ঠান আছে যারা ভ্যাকসিন আগে দেবে ইউরোপে। ইউরোপের চাহিদা শেষ করে তারপর বাকি বিশ্বের কাছে যাবে। এই যে পক্ষপাতিত্ব এবং টাকার দৌরাত্ম্য, এটা ভয়ংকর জিনিস। এই টাকার খেলা চলছে মানুষের জীবন নিয়ে। একজনের জীবনের ওপর আরেকজনের জীবনের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
আমরা ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে একটি আপিল করছি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্য। যেখানে পৃথিবীর প্রখ্যাত মানুষেরা একমত হয়ে স্বাক্ষর করছেন। একইসঙ্গে পৃথিবীব্যাপী এই আপিল করা হবে।
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন যেই আবিষ্কার করুক না কেন, এটাকে যেন সারা পৃথিবীতে ‘গ্লোবাল কমন গুডস’ হিসেবে দেওয়া হয়। কমন গুডস হচ্ছে— আলো বা বাতাসের মতো জিনিস, যা কেনাবেচা করা যায় না। করোনার ভ্যাকসিনে যদি কারও সত্ত্ব না থাকে, তাহলে তা হয়ে যাবে ওপেন সোর্স। যে কেউই এটা উৎপাদন করতে পারবে। আমরা বাংলাদেশে উৎপাদন করলে তা দেশে এবং দেশের আশপাশে যেসব জায়গায় সম্ভব সেখানে বিতরণ করব। ভারত তাদেরটা, জাপান, চীন বা অন্য যে কেউ তাদের চাহিদা অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে।
করোনার ভ্যাকসিন যদি আমেরিকা বা ইউরোপে আগে যায়, তাহলে আরেকটি সমস্যা হবে। তা হলো ভুয়া ভ্যাকসিন। একেবারে অবিকল আমেরিকা-ইউরোপের মতো বোতলে ভুয়া ওষুধ আপনার হাতে তুলে দেবে একটি চক্র। এটার একটা বিরাট ব্যবসা চলবে। এই অবস্থান থেকে আমরা বাঁচতে পারি, যদি পণ্যটি ওপেন সোর্স করাতে পারি।
এখন এই জায়গায় সামাজিক ব্যবসা একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে। পৃথিবীর সমস্ত ওষুধ প্রায় আধা ডজন প্রতিষ্ঠানের হাত হয়ে আসে।
আমরা এখন ফার্মাসিউটিক্যালের সামাজিক ব্যবসা শুরু করব। একটি ফার্মাসিউটিক্যাল করব। এই ভ্যাকসিন যদি ওপেন সোর্স হয়, তাহলে এটা দিয়েই আমাদের ফার্মসিউটিক্যাল যাত্রা শুরু করবে। যেখানে ওষুধের দাম হবে খরচের একেবারে কাছাকাছি। যাদের কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের বিনা মূল্যে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সাফল্য পেলে অন্যান্য ওষুধের দিকে যাব।
ওষুধের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়। মানুষের শ্রম, উৎপাদন খরচ যা হওয়ার কথা, তারচেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম রাখা হয়। জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে মানুষ ওষুধ খায়। প্রশ্ন তোলে না, ‘দাম এত বেশি কেন?’ এই প্রশ্ন এখন তোলার সময় হয়েছে। বাংলাদেশে একটি বড় কাজ হয়েছে। ওষুধ নীতির কারণে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিদেশি কোম্পানির জায়গায় দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বিকশিত হয়েছে। বিদেশে যারা থাকেন, তাদের অনেকে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ কিনে নিয়ে যান। এই জায়গাটিতে ফার্মাসিউটিক্যালের সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য ওষুধ সাধারণ মানুষের জন্যে সুলভমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে চাই। এই উদ্যোগ নিয়ে আমরা কাজ শুরু করতে যাচ্ছি।