
আব্দুর রহমান: সমাজ ও রাষ্ট্রে সাংবাদিকতার ভূমিকা কী হবে তা সাংবাদিকরাই জানে না। আমাদের দেশে সাংবাদিক হওয়া সবচেয়ে সহজ। প্রকৃতপক্ষে, সাংবাদিকতা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি। একজন সাংবাদিকের দক্ষতা একজন মানুষকে ধ্বংসের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে, আবার একজন সাংবাদিকের অজ্ঞতা একজন মানুষকে ধ্বংশ করে দিতে পারে। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের ইতিহাসে যুক্ত হলো এক বিভীষিকাময় দিন ৩০ জুন ২০২৫। এদিন দুপুরে প্রেসক্লাবের সামনে যে বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু কিছু সাংবাদিকের ওপর শারীরিক নিপীড়নের সীমায় আবদ্ধ নয়; এটি ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় এক ভয়ংকর আঘাত। কলম যে সত্যের প্রতীক-সেই কলম যখন রক্তে ভিজে যায়, তখন গোটা সমাজ ব্যথিত হয়, বিবেক কাঁদে। ডিবিসি টেলিভিশনের এম বেলাল হোসেন, দৈনিক ভোরের আকাশের আমিনুর রহমান, ঢাকার ডাকের তৌফিকুজ্জামান লিটুসহ অন্তত ১০ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন এই ঘটনায়। মাথা ফেটে রক্তাক্ত সাংবাদিকের ছবি দেখে কোনো বিবেকবান মানুষ নিশ্চুপ থাকতে পারে না। আহতরা এখন চিকিৎসাধীন; কেউ শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত, কেউ মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও প্রত্যাশিত প্রতিরোধ তারা দেখাতে পারেননি-এমন অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহলে। আমরা মনে করি, পেশাদারিত্বের প্রশ্নে পুলিশ ও সাংবাদিক-উভয় পক্ষকেই দায়িত্ববান আচরণ করতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা রক্ষায় উভয়েরই ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বিশেষভাবে স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করেছি, ঘটনার পরপরই সেনাবাহিনীর উপস্থিতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রেখেছে এবং সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। এটি একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা-রাষ্ট্র যেখানেই বিপদ, সেখানেই নিরপেক্ষ ভূমিকার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রস্তুত।
তবে বড় প্রশ্ন থেকে যায়-এমন ভয়াবহ সহিংসতা কেন? প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দুইটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান ছিল, যা এক সময় সীমানা ছাড়িয়ে রক্তক্ষরণে গড়ায়। নেতৃত্বের এই প্রতিযোগিতা যদি সংঘাতে রূপ নেয়, তাহলে আমরা কী বার্তা দিচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সংবাদকর্মীদের?
প্রেসক্লাব হলো মত ও তথ্য বিনিময়ের একটি পবিত্র মঞ্চ। এখানে মতভেদ থাকবে, থাকবে মতবিরোধও। কিন্তু মতের পার্থক্য কখনো রড-লাঠির মাধ্যমে সমাধান হতে পারে না। বরং আলোচনার মাধ্যমে, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করাটাই সবার জন্য সম্মানজনক পথ।
এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ বিচার। যারা এই হামলায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ হোক। প্রশাসনের দায়িত্বরতদের ভূমিকা নিয়েও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসুক। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার, প্রশাসন ও সাংবাদিক সমাজ-সব পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
আমরা মনে করি, এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময় এখনই। যে সংকটের জন্ম হয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে, তার সমাধান হতে হবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। সহিংসতা নয়-মুক্ত সংলাপ, ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাই হতে পারে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের নতুন পথচলার ভিত্তি।
একজন সাংবাদিকের কলম শুধু তার ব্যক্তিগত অস্ত্র নয়; তা সমাজের প্রতিবিম্ব, রাষ্ট্রের চেতনা এবং গণতন্ত্রের প্রহরী। তাই সাংবাদিকদের রক্ত নয়-চাই তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা। পরিশেষে আমাদের প্রত্যাশা, এই দুঃখজনক ঘটনার পরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব হয়ে উঠবে সকল সাংবাদিকের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরের প্রতীক। রক্ত নয়-বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ হোক সাংবাদিক সমাজের ঐক্যের ভিত্তি। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব হোক সাংবাদিক ঐক্য ও পেশাগত মর্যাদার প্রতীক-এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।
লেখক: সম্পাদক, সাহিত্যপাতা।