
জাতীয ডেস্ক:
নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পাতে খাসির পর গরুর মাংসও এখন বিলাসী খাবার। নির্ভরতা ছিল পোল্িট্র মুরগির মাংসে। সেটাও এখন নাম লিখিয়েছে বিলাসী খাবারের কাতারে। মাসখানেক আগে যেটা ১৫০-১৬০ টাকা কেজি ছিল, সেটা এখন ২৫০-২৬০ টাকা! এমনকি এখন ভরসা নেই গরীবের মাছ বলে পরিচিত পাঙ্গাসের বাজারেও। ১২০-১৪০ টাকার পাঙ্গাস এখন প্রতিকেজি ২০০’র ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। এমন পরিস্থিতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বলছেন, ‘কী খামু আর ক্যামনে চলুম?’
দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে সাধারণ মানুষের আমিষের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় আমিষের চাহিদা পূরণে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কথা হচ্ছিল পেরেক কারখানা শ্রমিক সফিয়া খাতুনের সঙ্গে। এসেছেন পরিবারের সাপ্তাহিক বাজার করতে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল নিত্যপণ্যের দাম কেমন দেখছেন? জবাবে তিনি জানালেন, ‘কোন জিনিসটা দাম না, কন? আমরা কী খামু, আর কিভাবে চলমু? পাঙ্গাস মাছ আগে আছিল ১২০-১৩০ টাহা, অহন ১৮০-২০০ টাকা। ক্যামনে কিনমু, আর ক্যামনে খামু।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে পরিবারের খাওয়া-ঘর ভাড়া যোগাড় করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে সফিয়া খাতুনের। এমন পরিস্থিতিতে ঘরে বিবাহ উপযোগী মেয়ে থাকলেও তাকে বিয়ে দিতে পারছেন না তিনি। বলছেন, ‘বিয়া দিমু ক্যামনে! জামাইরে তো কিছু না কিছু দিবার লাগবো, সব জিনিসের যে দাম।’
গরুর মাংস শেষ কবে খেয়েছেন- সেটা মনে করতে বেশ খানিকটা সময় নিলেন সফিয়া খাতুন। মনে করে বললেন, ৬ মাসে তো কিনিনি। গেল কোরবানি ঈদে সবশেষ গরুর মাংস খেয়েছেন বলে জানালেন তিনি।
ঊর্ধ্বগতির এ বাজারে আসন্ন রমজানে আরও শঙ্কা বাড়াচ্ছে জানিয়ে বললেন, এক কেজি চিনি কত কন? গরীব ঘরে যে ট্যাং গুলিয়ে খাবে সেটাও তো পারবে না। সব জিনিসের দাম বাড়ছে, বেতন বাড়ে না- ক্যামনে চলে মানুষ।
এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ আমিষ গ্রহণের পরিমাণ কমিয়েছে বলে জানাচ্ছে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুল আরেফিন বলছেন, ডাল থেকে আমিষ পেলেও প্রাণীজ আমিষই (মাছ-মাংস) হচ্ছে প্রথম শ্রেণির আমিষ। মানুষের শরীরে আমিষের ঘাটতি হলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। শিশুদের দীর্ঘমেয়াদে নানা রোগ দেখা যাওয়া সহ পুষ্টিহীনতায় বর্ধন কমে যেতে পারে।
বর্তমান বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাজারে মানুষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের এ সঙ্কট আরও প্রকট। এমন পরিস্থতিতে প্রাণীজ আমিষের ঘাটতি পূরণে পণ্যের দাম সহনশীল পর্যায়ে রাখার তাগিদ তার।
আর সেটি সম্ভব না হলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে তাগিদ অধ্যাপক ড. সাইদুল আরেফিনের।
পরিবারের সদস্যদের জন্য বাজার করতে এসেছেন হাসেম মিয়া। সাম্প্রতিক বাজারের অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে। বললেন, আমাদের মতো গরীবের খাসির মাংস বা গরুর মাংস খাওয়ার মতো পরিস্থিতি নাই। দিন দিন দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। এখানে দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ‘পরিচালকেরা’ রয়েছে- যারা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দায়িত্বশীলতার বড় অভাব। এটা দেখার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার এটা দেখছে না।
প্রচার এবং বাজারের প্রকৃত অবস্থা আকাশ-পাতাল তফাৎ বলে মন্তব্য তার। তিনি বলছেন, এরা শুধু আছে উন্নয়ন নিয়ে। উন্নয়ন কী হচ্ছে, আমরা গরীব মরে যাচ্ছি। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লে চাপটা পড়ে জনগণের ওপর। যে বিক্রি করছে তার ওপর কিন্তু পড়ছে না। আমাদের কিনে খেতে হচ্ছে। এখানে আমাদের কী করার আছে।
ধনী-গরীবের পার্থক্য দিন দিন যোজন যোজন বাড়ছে বলে মন্তব্য হাসেম মিয়ার। উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, বড় লোক দিন দিন বড় লোক হচ্ছে, গরীব আরও গরীব হচ্ছে। তারা এক হাজার-দুই হাজার-পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা ইলিশ মাছ কিনে খেতে পারে। আমরা তো আর খেতে পারি না। মাছ তো ঠিকই গেছে, মাছ কি বাজারে আছে?
‘সব কিছুতে বাড়তি দাম, চলতে কষ্ট হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে গরীব মরনের অবস্থা’ বলে মূল্যায়ন তার।
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির মূল্য তালিকায় এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের মূল্য ১৮৫, চিনির মূল্য ১১০ থেকে ১২০ টাকা। হলে খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন ১৯০ টাকা এবং চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। প্যাকেটজাত চিকন দানার লবনের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ টাকা পর্যন্ত।
প্রাণীজ আমিষের মধ্যে খাসির মাংস ১১০০, ছাগলের মাংস ৯০০, হাঁড়সহ গরুর মাংস ৭৫০, ব্রয়লার মুরগি ২৫০, সোনালী মুরগী ৩৪০, পাঙ্গাস মাছ ২০০, চাষের কৈ মাছ ২৪০, তেলাপিয়া ২২০, রুই মাছ ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
তেজিভাব সবজির বাজারেও, স্বস্তির খবর নেই সাধারণ মানুষের। দু-একটি বাদে অধিকাংশ সবজী বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার বেশি দরে। প্রতিকেজি বেগুন ৬০, করলা ৮০, শিম ৬০, শসা ৪০, গাজর ৪০, টমেটো ৩০, মিষ্টি কুমড়া ৪০, ঢেঁড়স ৮০, কচুর লতি ৮০, চিচিঙ্গা ৬০, মরিচ ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।