
হাফিজুর রহমান, কালিগঞ্জ থেকে: ১৯৭১ সালে জাতির জনক স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়াদী উদ্যানে) ৭ মার্চ তার দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলে সারা বাংলাদেশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন বাংলার দামাল ছেলেরা ছাত্রজনতা কৃষক, মজুর, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে সারা বাংলাদেশের ন্যায় ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের নেতৃত্বে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে তৈরি হয়েছিল ২৩ সদস্যের “কালিগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদ” কালিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ আট মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে কালিগঞ্জ অঞ্চল কে ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে। পাকসেনাদের হটিয়ে ডাকবাংলা ঘাঁটি দখল করে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা করে। তবে এ যুদ্ধে কালিগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধাদের তেমন কোনো হতাহত করতে পারেনি। পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অনেক পাক হানাদার বাহিনীর সেনা সদস্যরা প্রাণহারায় এই মাটিতে। সেদিন ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার নেতৃত্বে ২০ নভেম্বর দুপুরে প্রথমে ওয়াপদার ডাকবাংলা এ অবস্থিত পাক সেনা ঘাঁটি দখল করে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এরপর সোহরাওয়ার্দী পার্কে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭১ সালের ৪ মার্চ কালিগঞ্জের ডাকবাংলো চত্বরে শত শত মানুষ একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ সহবাসের মাধ্যমে পুড়িয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের পতাকা। এসময় উত্তেজিত জনতা লাঠি মিছিল করে কালিগঞ্জ সদর ঘেরাও করে কেঁপে উঠেছিল কালীগঞ্জের ছাত্র সহ সকল উত্তেজিত জনতা সেদিন কালিগঞ্জ এর মুক্তিযোদ্ধারা ঠিক করেছিল যশোরে এ পাশে পাক হানাদার বাহিনী বা সেনাবাহিনীকে আসতে দেওয়া হবে না। ১০ ও ১১ এপ্রিলের দিকে রটে যায় পাক আর্মি কালিগঞ্জের দিকে আসছে। এখবর শুনে ক্রোধে ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সংগ্রাম পরিষদ। দ্রæত এলাকার সমস্ত বন্দুকধারীদের সংঘবন্ধ করে কালিগঞ্জ বাজার থেকে থানা পর্যন্ত নদীর তীরে গেওয়া বাগানের ঝোঁপের মধ্যে পজিসন নিয়েছিল বন্দুকধারীরা। হঠাৎ রটে গেল সংগ্রাম পরিষদের একটা নামের লিস্ট পাক আর্মির কাছে পৌছে গেছে। সে মোতাবেক জন্মভ‚মি ত্যাগ করে ১৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যায়। এদিকে সকল বাধা বিপত্তি মায়া মমতা কাটিয়ে মে মাসের মধ্যে শত শত দামাল ছেলেরা দেশমুক্তির শপথ নিয়ে মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য চলে যায়। এদিকে পাক আর্মি ঘাঁটি গাড়লো ওয়াপদা ডাক বাংলা ভবন, বসন্তপুর চন্দ্রদেবের পরিত্যাক্ত বাড়ি, কালিগঞ্জ হাসপাতালের সংলগ্ন এলাকা, দমদম ফেরি ঘাটের বরফকল এবং খানজিয়া ই.পি.আর ক্যাম্প। দ্রæত তাদের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করে সাদপুর ব্রীজ, ভাড়াশিমলা, সুইলপুর, খানজিয়া, নাজিমগঞ্জ, বসন্তপুর, উকস্ াপিরোজপুরসহ গোটা সীমান্ত এলাকা ঘিরে ফেলে হায়না বাহিনী নিরিহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এসময় তারা সারা দেশের ন্যায় কালিগঞ্জেও গঠণ করে পিস কমিটি ও রাজাকার বাহিনী। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিশোধ স্পৃহায় দ্রæত আর্মস ট্রেনিং নেয় ভারতের হিঙ্গলগঞ্জসহ বিভিন্ন শিবিরে। মে মাসের মধ্যে ট্রেনিং শেষে তারা ফিরে আসেন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে। ৯নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল ও তার সহযোগি ক্যাপ্টেন ন‚রুল হুদা, লে. বেগ, লে. আরেফিন ও লে. শচীন এদের নেতৃত্বে জুন থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে নিজ বাসভ‚মির উপর কৌশলে হায়না বাহিনীর উপর অসংখ্য আক্রমন পরিচালনা করে। এসময় পাক সেনারা কালিগঞ্জ দখলে রাখতে বিভিন্ন ক্যাম্পে ভারী অস্ত্র মেশিনগ্যান, কামান, মটার ইত্যাদি মজুদ করে। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোজ খবর পেতে তারা গোয়েন্দা নিয়োগ করে। তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রের বিরুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা দেশীয় নিম্ন মানের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মনোবল কে সম্বল করে অসম যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রথমে তারা বসন্তপুর বিওপি, খানজিয়া ক্যাম্প ও কালিগঞ্জ থানা সদরের বিওপি ক্যাম্পের উপর আক্রমণ শুরু করে। পরে বাগবাটি, পিরোজপুর, ভাড়াশিমলা, রতনপুর, নজিমগঞ্জ, উকস্,া দুদ্লীসহ বিভিন্ন পাক ঘাঁটিতে বারবার চোরাগুপ্তা আক্রমণ করে পাক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অক্টোবর ও নভেম্বরে কালিগঞ্জ একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আক্রমন পাল্টা আক্রমন আর রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, রকেট লাঞ্চারের শব্দে ও আগুনে কালিগঞ্জের আকাশ, বাতাস, মাটি, প্রকম্পিত হতে থাকে। উকসা বিওপি ক্যাম্প আক্রমন পিরোজপুর ও খানজিয়ার সম্মুখ সমরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কালিগঞ্জের আপামর জনসাধারণ পাকিস্তানী নরপশুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সে সময় সকল স্থরের জনতা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে থাকে। এযুদ্ধে কালিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা খুব বেশী হতাহত না হলে ও পাক বাহিনীর অনেক সৈন্যদের প্রাণ হারাতে হয়েছিল সেদিন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে হানাদার বাহিনী ২০ নভেম্বর ভোরে কালিগঞ্জ ছেড়ে সাতক্ষীরার পুস্পকাটি নামক স্থানে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এখবরে উল্লাসিত হয়ে ২০ নভেম্বর কালিগঞ্জের ডাকবাংলা চত্বরের বকুল তলায় মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কালিগঞ্জের স্বাধীনতার শুভ সুচনা করেন।