করোনাভাইরাসের বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির সব খাত ঠিক হতে কতটা সময় লাগবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এর মধ্যেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ‘অর্থনৈতিক উত্তরণ ও ভবিষ্যৎ পথপরিক্রমা’ শিরোনামে যে বাজেট তিনি উপস্থাপন করবেন তার আকার পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বেশি। শতাংশ হিসাবে ৮.৫৬ শতাংশ বেশি। বাজেটে ঘাটতি সাধারণত ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়। করোনার প্রভাবে প্রথমবারের মতো তা ৬ শতাংশ স্পর্শ করছে। অর্থনীতিবিদরা রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বললেও অর্থমন্ত্রী তাতে কান দেননি। মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজেটের যে আকারের কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। বাজেটের আকার নির্ভর করে রাজস্ব আদায়ের ওপর। আর আমাদের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির অবস্থা খুবই নাজুক। শুধু শুধু বিশাল রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে লাভ নেই। এটা অর্জন করা যাবে না। তা ছাড়া এত বড় বাজেট ব্যয় করার মতো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অনেক মন্ত্রণালয় ব্যয় করতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘বাজেটে যে ৮.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে, তা পুরোপুরি অবাস্তব। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, বড়জোর ৪ থেকে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। ঘাটতি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। বড় ঘাটতি হতেই পারে। তবে আগামী বাজেটে সুশাসন, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’
বাজেট পরিসংখ্যান : ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার ৪৪ হাজার ৮১০ কোটি টাকা বাড়ছে। আগামী বাজেটে মোট রাজস্ব আয় (অনুদানসহ) ধরা হয়েছে তিন লাখ ৮২ হাজার ১৬ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর অনুদান ছাড়া রাজস্ব আয় তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। সে হিসাবে রাজস্ব আয় বাড়ছে ১৯০ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেটে করবহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর কর ছাড়া প্রাপ্তির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার তিন কোটি টাকা। আগামী বছরে বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে চার হাজার ১৩ কোটি টাকা।
অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর কথা বলা হলেও আগামী অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ তিন লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে আবর্তক ব্যয় ধরা হয়েছে তিন লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আবর্তক ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় হবে পাঁচ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। আর এডিপিবহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ৭২২ কোটি টাকা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে ব্যয় করা হবে দুই হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। এডিপি ইতিমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
আয় এবং ব্যয়ের বিশাল পার্থক্যের কারণে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির (অনুদানসহ) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫.৮ শতাংশ। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) এক লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। সে হিসাবে আগামী অর্থবছরে অনুদান ছাড়া ঘাটতি ৪৪ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা বাড়ছে।
ঘাটতি বাজেট পূরণ করা হয় অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে। আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৯ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৩২ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে আগামী বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার ঋণ নেবে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়াসহ প্রণোদনার সুদ ব্যয়ের কারণে সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ৮২ হাজার ৪২১ কোটি টাকা করা হয়।
নতুন বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৬ হাজার চার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে ৫২ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
করোনাভাইরাস কত দিন থাকবে তা কেউ বলতে পারছেন না। এ ভাইরাসের প্রভাবে মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে কমে গেছে ক্রয় ক্ষমতা। এতে এমনিতেই মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলবে। ফলে সরকার আশা করছে, আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫.৪ শতাংশে বেঁধে রাখা যাবে। অর্থনীতিবিদ কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যাই বলুক না কেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। করোনাকাল শিগগিরই কেটে যাবে—এমন আশায় এ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে।
সংশোধিত বাজেট : চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ এক হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আদায় করা সম্ভব হয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর ১১ মাসের প্রাথমিক হিসাবে এই ঘাটতি ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসব কারণ বিবেচনায় এনে রাজস্ব আয়ে ২৯ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজার ৬৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্য ২৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। ফলে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তিন লাখ ৫০০ কোটি টাকা।
সংশোধিত বাজেটে আট হাজার ১২৮ কোটি টাকা ঘাটতি বাড়ানো হয়েছে। এতে অনুদান ছাড়া সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৩ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৮.২৩ শতাংশ। করোনার আঘাতে অর্থনীতির লণ্ডভণ্ড অবস্থায় সরকার তা কমিয়ে ৫.২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সূত্র: কালের কন্ঠ