
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর ব্যুরো: সুন্দরবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও ঝুঁকি ভাতা পাস করার পরও কমেনি দুর্নীতি অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্য। সরকার সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এনে প্রতিটি দপ্তরে সাফল্য অর্জন করে দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, সুন্দরবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জেলে-বাওয়ালীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণসহ নানা দুর্নীতি অনিয়ম বৃটিশের শাসন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি পর্যন্ত চলমান আছে। যাহা দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার। একদিকে বনদস্যুদের অপহরণ, মুক্তিপণ বাণিজ্য, অন্যদিকে বনবিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ গ্রহণের কারণে নাজেহাল হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জেলে-বাওয়ালীরা। সরেজমিনে ও প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জ-এর বনকর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ বাণিজ্যসহ বহুপ্রকার অভিযোগের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার সরকারিভাবে বন্ধ থাকলেও সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের জেলেরা অনুমতি বিহীন বনবিভাগের নাকের ডগায় তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় কাঁকড়া, মাছ আহরণ করছে। বনবিভাগের নিয়মিত টহলে তাদের চোখে পড়ে না এধরনের অপরাধ। তারা যেন না জানার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে। ২জন জেলের ১ সপ্তাহের পাসে সামান্য সরকারি রাজস্ব থাকলেও তা প্রতি পাসে ৯০০টাকা আদায় করেন কৈখালী, কদমতলা, বুড়িগোয়ালিনী ও কোবাদক স্টেশন কর্মকর্তা। তবে তারা সরাসরি এ টাকা গ্রহণ করেন না। প্রতিটি স্টেশনে ডজন ডজন দালাল নিয়োগ দেওয়া আছে। তাদের মাধ্যমে এই টাকা নিয়ে থাকেন। আর ৭দিনের প্রবেশ কর নিয়ে পাস দিয়ে পাস সর্মপণের সময় ৭দিনের রাজস্ব নিয়ে সরকারের কোষাগারে জমা দেয় ৩থেকে ৫দিনের রাজস্ব। একদিকে জেলেদের কাছ থেকে ঘুষ বাণিজ্য করছে, অন্যদিকে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে। সরকারি নীতিমালায় জেলেরা মাছ আহরণ করে ফিরে এসে পাস সর্মপণ করার পর তাদের সর্মপণ পাস বা সিটি পাস দেওয়ার নির্দেশ থাকলেও থলের বিড়াল বেরিয়ে আসার ভয়ে জেলেদের সিটি পাস না দিয়ে তা বনরক্ষীরা জ্বালানী হিসেবে পুড়িয়ে দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশনে ৩ হাজারের অধিক মাছ-কাঁকড়া ধরার বিএলসি রয়েছে। এসমস্ত বিএলসি ধারীরা নিয়মিত সাদামাছ,কাঁকড়ার পাস নিতে দালালদের মাধ্যমে বনরক্ষীদের ঘুষ দিয়ে বন্ধ মৌসুমে অবাধে কাঁকড়া ও মাছ আহরণ করছে।
এ দিকে পশ্চিম সুন্দরবনের লটাবেঁকী টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় টহল ফাঁড়ির ট্রলার দিয়ে শত শত নৌকা সাদা মাছের পাস নিয়ে কাঁকড়া আহরণের জন্য অভয়ারণ্য এলাকায় টেনে নিয়ে কাঁকড়া ধরাচ্ছে। কাঁকড়া ধরার পর আবার তাদের ট্রলারে নৌকাগুলো টেনে এনে বিভিন্ন মোকামে পৌঁছে দিচ্ছে। সুত্র জানায়, এসমস্ত জেলেরা অভয়রণ্য এলাকা যেমন-আগুনজ্বালা, পান্তামারী, ইলশেমারী, খেজুরদানা, হেতালবুনিয়া, জনাবের ভারানি, ভাইজোড়া খাল, লতাবেঁকী খালসহ অসংখ্য অভয়ারণ্য এলাকায় লতাবেঁকী টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীদের সহযোগিতায় বন্ধ মৌসুমে কাঁকড়া আহরণ করছে। জেলে প্রতি লতাবেঁকীর বনরক্ষীরা সপ্তাহে ৪ হাজার টাকা করে ঘুষ নিচ্ছে। এভাবে প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ বাণিজ্য করছে। দেখার কেহ নেই।
“স্মার্টটিম” দীর্ঘদিন থেকে পশ্চিম সুন্দরবনে নামানো হয়েছে। যার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লটাবেঁকী টহলফাঁড়ির ওসি নাসির উদ্দীন ও কৈখালী স্টেশন কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম। কিন্তু, অদ্যাবধি তাদের কোন ধড়-পাকড় বা জব্দ করার মত কোন খবর নেই। একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এই “স্মাট-টিম” পরিচালনার জন্য কোটির অধিক টাকা বরাদ্ধ দিয়াছে। স্মাট টিম মাঝে মাঝে দুই-একটা ট্রলার,নৌকা ও জাল জব্দ করলেও তা ঘটনাস্থল থেকে উৎকোচ নিয়ে আসামীদের ছেড়ে দিচ্ছে। আরাম-আয়েশ আর স্প্রিট-বোটের বরাদ্ধের তেল কিনেই পার হয়ে যাচ্ছে স্মার্ট-টিমের দৈনন্দিন কাজ। তাদের কাজের কোন অগ্রগতি নেই। সূত্রটি আরও জানায়, শুধু বনবিভাগের জনবল দিয়ে স্মার্ট টিম চালালে সরকারের টাকা অপচয় ছাড়া কোন কাজে আসবে না। সুন্দরবন থেকে ফিরে আসা অনেক জেলেরা বলেছেন,স্মার্ট টিম এবার সাদা মাছ ও কাঁকড়া আহরণকারীদের কাছ থেকে দেখা পেলেই ডিউটি খরচের অজুহাতে ১ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। বনবিভাগের এই সমস্ত নানামুখী ঘুষ বাণিজ্য অনিয়ম সেই বৃটিশ আমল থেকে চলে আসছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক, সাংবাদিক-এর প্রতিবাদ করলে বনরক্ষীরা নানা অভিযোগ খাঁড়া করে জেলেদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে। জেলেরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে জীব জীবিকা নির্বাহ কারর জন্য ঘুষ বাণিজ্যসহ সকল অনিয়মের সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করতে বাধ্য হয়। জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক ও স্থানীয় সাংবাদিক যারা ঘুষ বানিজ্যসহ বনরক্ষীদের নানা অপকর্মের প্রতিবাদ করেন বনবিভাগের অসৎ কর্মকর্তারা উদোর বোঝা বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বন মামলা দেন। এমন মামলায় উপকূলীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবক ও সাংবাদিকরা অনেকই ভুগছে। যা আদালতে শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয় না। অবশেষে বিচারকরা খারিজ করে দেন। এই সমস্ত পাতানো মামলার করণে বনবিভাগের ৯৫% ভাগ মামলার দায় হতে আসামীরা অব্যহতি পাচ্ছে। কারণ, মিথ্যা মামলায় ঝুলিয়ে রাখায় স্বাক্ষীও স্বাক্ষ্য দিতে চায় না। নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মিথ্যা মামলা দাখিল করায় বন কর্মকর্তা।এঅভিযোগ আদালতে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বন মামলা পরিচালকের। এভাবে বনবিভাগ সরকারের টাকা অপচয় করছে। এজন্য দরকার দক্ষ বন কর্মকর্তা যারা দেশ ও জাতির উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। সেজন্য, নতুন এবং দক্ষ জনবল নিয়োগেরও প্রয়োজন আছে। তবে একটি অভিজ্ঞ মহল বলতে চায়, র্যাবে আর্মি অফিসার আছে, কোস্টগার্ডে আর্মি অফিসার আছে, বিজিবিতে আর্মি অফিসার আছে। এমন অসংখ্য সরকারি দপ্তর বা প্রশাসনে সেনাবাহিনী অফিসার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সে সমস্ত দপ্তর বা প্রশাসনে অনিয়ম দূর্নীতির পরিমাণও খুবই কম। বনবিভাগের সহকারি বন সংরক্ষক পদ থেকে উচ্চ পর্যায়ে আর্মি অফিসার নিয়োগ দিয়ে যদি বনবিভাগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে বনবিভাগের ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ঘুষ কেলেঙ্কারীসহ নানাবিধ দূর্নীতি দূর হতে পারে। তাহা না হলে এটা বন্ধ হওয়ার কোন আলোর পথ দেখা যাচ্ছে না। এধরনের নানা অভিযোগের কারণ জানতে চেয়ে কথা হয় খুলনা বিভাগীয় কর্মকর্তা বশিরুল আল মামুনের সাথে। তিনি বলেন, “ভাই অভিযোগ সবে আপনি জানালেন, বিষয়টি অতি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে দেখছি। প্রমাণিত হলে দায়িদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”