
অনলাইন ডেস্ক :
কক্সবাজারের টেকনাফের বহুল আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ‘সর্বশেষ’ তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কমিটি এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুলি করার পরও অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা বেঁচে ছিলেন। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। তাকে বহনকারী পিকআপ হাসপাতালে দেরিতে পৌঁছায়। এর পেছনেও দায়ী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
বৈঠকে অংশ নেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান, মো. ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, মো. মোতাহার হোসেন, মো. নাসির উদ্দিন, মো. মহিববুর রহমান এবং বেগম নাহিদ ইজাহার খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষা সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী, আবহাওয়া অধিদফতর ও জরিপ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সংসদীয় কমিটি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ পর্যবেক্ষণে রাখার কথা বলেছে। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে যাতে কেউ ফায়দা লুটতে না পারে, সেদিকে নজর রাখার কথাও বলেছে সংসদীয় কমিটি।
গত আগস্ট মাসে কমিটির বৈঠকে বিষয়টি আলোচ্য সূচিতে ছিল না। তবে এ নিয়ে কথা তোলেন কমিটির সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান। কমিটির পরের বৈঠকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ওই বৈঠকে সুপারিশ করা হয়। বুধবার বৈঠকে ওই ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
কমিটির কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার সঙ্গে জড়িত এসপি মাসুদ। ঘটনার শুরু থেকে তদন্তের কাজে অসহযোগিতা ও বাধা দিয়ে আসছেন তিনি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার পরপরই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার পরিবার এসপি মাসুদকে বদলির দাবি তুলে। সুষ্ঠু তদন্তের এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাকে বদলি করা দরকার বলে মত পোষণ করে সেনাসদরও।
বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য ফারুক খান বলেন, কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনা উঠলে আজ আমি বলেছি- এই বিচার কাজ সার্বক্ষণিক মনিটর করতে হবে। কেউ যাতে এ থেকে ফায়দা লুটতে না পারে। মন্ত্রণালয় আমাদের জানিয়েছে- এ ঘটনার বিচারে যা যা করা দরকার, সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় সবকিছু নজরে রেখেছে।
গত ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউপির শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় গত ৫ জুলাই তার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করা হয়।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর পর ঘটনাটিকে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল পুলিশ। তার ভিত্তিতে পুলিশের পক্ষ থেকে মামলাও হয়েছিল। তার বাদী হয়েছিলেন নন্দলাল রক্ষিত।
অন্যদিকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বোন শারমিন সরাসরি হত্যার অভিযোগ এনে কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনকে মামলায় আসামি করতে আদালতে আবেদন করেছিলেন। তবে বিচারক তা খারিজ করে দেন। ওই ঘটনার জেরে গত সেপ্টেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে এসপি মাসুদ হোসেনকে রাজশাহী বদলি করা হয়।
মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে সেদিনকার ঘটনার বিবরণও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, গত ৩১ জুলাই ২০২০ তারিখ আনুমানিক ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় টেকনাফ থানার আওতাধীন মেরিন ড্রাইভ এলাকায় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীর গুলিবর্ষণে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হন।
প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩ জুলাই ঢাকা থেকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীসহ ‘জাস্ট গো’ নামে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ট্রাভেল ভিডিও তৈরির নিমিত্তে কক্সবাজারে আগমন করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা। তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে নীলিমা কটেজ নামক একটি রিসোর্টে অবস্থান করে একমাস যাবত কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন।
এতে বলা হয়, ৩১ জুলাই ২০২০ তারিখে রাত্রিকালীন শুটিং শেষে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাসহ সঙ্গীয় সাহেজুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে মারিশবুনিয়া পাহাড় থেকে নেমে নিজস্ব প্রাইভেটকার করে মেরিনড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা করেন। পথিমধ্যে শামলাপুরের আগে বিজিবি চেকপোস্টে তাদের তল্লাশি করার জন্য থামানো হয়। পরিচয় প্রাপ্তির পর ছেড়ে দেয়া হয়।
আনুমানিক ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্ট অতিক্রমের সময় ইন্সপেক্টর লিয়াকত এপিবিএনের ফোর্সসহ অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার গাড়ি থামায়। তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের পরিচয় দিলে এপিবিএন সদস্যরা প্রথমে তাদের যাওয়ার জন্য সংকেত দিলেও ইন্সপেক্টর লিয়াকত তাদের পুনরায় থামায়। তাদের দিকে পিস্তল লক্ষ্য করে গাড়ি থেকে নামতে বলে। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দিকে গমন করে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই ইন্সপেক্টর লিয়াকত খুব কাছ থেকে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনার আনুমানিক ২০-২৫ মিনিট পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করে বলে জানা যায়।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ মিনিট অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার আহত দেহ ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল এবং তিনি তখনো জীবিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, উক্ত পুলিশ চেকপোস্টটি এপিবিএন কর্তৃক পরিচালিত এবং ঘটনার সময় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ঘটনাস্থলে উপস্থিতি ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা এবং পরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে বলে প্রতীয়মান।
পরবর্তী সময়ে রাত ১০ টার সময় একটি পিকআপ সহকারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। আনুমানিক এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পরে পিকআপটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, স্বাভাবিক সময়ে উক্ত দূরত্ব অতিক্রমে এক ঘণ্টা সময় লাগলেও অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করে সিনহাকে বহনকারী পিকআপ হাসপাতালে পৌঁছানোর পেছনেও দায়ী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা ছিল বলে প্রতীয়মান।
এতে বলা হয়, উক্ত ঘটনার অব্যাবহিত পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাসদস্যদের পক্ষ হতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে একটি যৌথ তদন্ত আদালত গঠনের নিমিত্তে পত্রালাপ করা হয়। ফলশ্রুতিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার সঠিক কারণ নিরূপণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে (যুগ্ম সচিব) আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে যৌথ তদন্ত কমিটি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। একই সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার কারণ উদ্ঘাটনের নিমিত্তে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত আদালত গঠিত হয়। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এখানে উল্লেখ্য যে, স্থানীয় সূত্র এবং বিভিন্ন মাধ্যম হতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কক্সবাজারের এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ঘটনার তদন্তের শুরু থেকেই অসহযোগিতা ও বাধা প্রদান করে আসছেন বলে জানা যায়।
এছাড়াও উপরোল্লিখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বোন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকতসহ মোট ৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার তদন্তভার র্যাবের ওপর ন্যস্ত করা হয়।
র্যাব ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জন আসামিকে (৩ জন বেসামরিক ও ৬ জন পুলিশ সদস্য) পর্যায়ক্রমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রিমান্ড শেষে এপিবিএনের তিনজন সদস্য এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। একই সঙ্গে তিন বেসামরিক ব্যক্তিও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে বলেও জানা যায়।
এখানে উল্লেখ্য, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস কোনো প্রকার জবানবন্দি প্রদান করেনি। সব আসামিরা এখন কক্সবাজার জেলা কারাগারে আছে। বর্তমানে মামলাটি র্যাবের অধীনে তদন্তাধীন আছে। আটককৃত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। সিফাত ও শিপ্রা জামিনে রয়েছেন।