সচ্চিদানন্দ দে সদয়: শারদীয়া দুর্গাপূজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয়। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাঁদের পূজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে এই পূজার নাম হয় ‘অকালবোধন’। দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন।প্রথা অনুযায়ী দেবী দুর্গার অষ্টমীবিহিত সন্ধিপূজায় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও রামচন্দ্র শুধু ১০৭টি পদ্মের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। এসময় নিরুপায় হয়ে তিনি ১০৮তম পদ্মস্বরূপ তাঁর নিজের চোখ উপড়ে নিতে উদ্যত হন। কথিত আছে যে, পতিতপাবন রামের চোখকে নীল পদ্মের সঙ্গে তুলনা করা হত বলে তাঁর অপর নাম ছিল ‘পদ্মলোচন’। মা দুর্গা রামের একনিষ্ঠতা দেখে খুশি হয়ে স্বয়ং রামের সামনে আবির্ভূতা হন এবং দৈত্যরাজ রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য রামচন্দ্রকে আশীর্বাদ করেন। মা দুর্গার এই অসময়ে আবাহন বাংলায় ‘অকালবোধন’ হিসাবে পরিচিত হয়। তারপর থেকেই শরৎকালে দেবী দুর্গার পূজা প্রচলিত হয়। শরৎকালীন দুর্গাপূজা শারদোৎসব নামে পরিচিত হয় এবং সমস্ত বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বৃহদাকারে পালিত হয়। বসন্তকালীন দুর্গাপূজা বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত যা ঐতিহ্যগতভাবে মূল দুর্গাপূজা হলেও শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপনের কারনে তা প্রায় হারিয়ে গেছে।আমরা যেমন ঘর-সংসার, স্বামী সন্তান, আত্মীয় পরিজন ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি না, আমরা দুর্গার ক্ষেত্রেও তাই দেখতে চেয়েছি। লৌকিক দুর্গা আমাদের মাঝে দেখা দেন সপরিবারে। বাঙালির আপন মনের মাধুরী মেশানো দুর্গা তার সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে নিয়ে কৈলাশ থেকে হিমালয়ের ঘরে বাপের বাড়ি আসেন। বাঙালির ঘরে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আসার মতো আনন্দ। যেমন পরিবারে সবাই আপন, সেরকম জগজ্জননীর বিশ্বসংসারে আমরা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ী বৈশ্য, শাসনকর্তা- সবাই বিশ্বজননীর সন্তান- সরস্বতী, কার্তিক, লক্ষ্মী ও গণেশের মতো সবাই আপন। সন্তানদের কল্যাণের জন্য মা দুর্গা সর্বদাই উদগ্রীব। তাই ১০দিক থেকে সন্তানদের রক্ষা করার জন্য তিনি ১০ হাতে ১০ অস্ত্র ধরেছেন।যখন মানুষ ভোগতৃষ্ণায় পরিতৃপ্তি লাভের ইচ্ছায় বা বিষয়াসক্ত হয়ে ইন্দ্রিয়ের পশ্চাতে ধাবিত হয়, জগতের অনিত্য বস্তুকে সত্য মনে করে, জীবনের পরম সত্যকে ও ধর্মকে ভুলে থাকে, তখন মানুষের ভেতর আসুরিক ভাবের প্রকাশ পায়। আবার সেই ইন্দ্রিয়গুলোকেই সংযত করে যদি অনাসক্তভাবে কল্যাণ কাজে ও পরমার্থ চিন্তায় নিয়োজিত করা যায় তখনই মানুষের দৈবীভাবের প্রকাশ হয়। দুর্গাপূজার প্রতিমায় মহিষাসুরকে আসুরিক ভাবের প্রতীক এবং মহিষকে কামের প্রতীক বলে মনে করা হয় যা ভক্তের শত্রু বলে বিবেচিত; দুইই মায়ের পদতলে মর্দিত হয় এবং অস্ত্রাঘাতে বিনাশপ্রাপ্ত হয়।পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয় ও মনকে একাগ্র করার ও শুদ্ধ করার প্রয়াস পাই। আমাদের চিত্ত শুদ্ধ হলে মা আমাদের হৃদয়ে প্রকাশিত হন, আমরা আমাদের আনন্দময় স্বরূপ উপলব্ধি করি। মা শরণাগত সন্তানকে দশহাতে সতত সর্বপ্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করে অভয় দিচ্ছেন, সন্তানকে কল্যাণ কাজের শক্তি ও প্রেরণা দিচ্ছেন এবং পরম লক্ষে পরিচালিত করছেন। আবার এ পূজায় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজায় বলির বিধান রয়েছে। আসুরিক শক্তির বিনাশ ও দৈবী শক্তি প্রকাশ সম্পর্কিত অনুকল্পের অনুষ্ঠানিক রূপ। দুর্গাপূজা সমাজের সকল বর্ণ, শ্রেণী ও পেশার, সকল স্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব; সকলের কল্যাণ ভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডানপাশে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পার্শ্বে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও সম্পদের, গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। একটা সমাজ বা রাষ্ট্রের যথার্থ উন্নতি ও অগ্রগতি তখনই তরান্বিত হয় যখন জ্ঞানের চর্চা, সুদক্ষ প্রতিরক্ষা, পর্যাপ্ত ঐশ্বর্য বা সম্পদ এবং জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি ও ঐক্যে দেখা যায়। আদর্শ সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রে উক্ত চারটি মৌলিক বিষয়ের সমন্বিত ব্যবস্থা যে অত্যাবশ্যকীয়, তা চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করেন। দুর্গাপূজা আমাদের মধ্যে আপাতঃবিভেদ ও বৈষম্য দূর করে সম্প্রীতির ভাব দৃঢ় করে এবং ঐক্যবোধের প্রেরণা যোগায়। এ পূজার মাধ্যমে আদর্শ সমাজের শান্তিপূর্ণ রূপটিই যেন আমাদের কাছে প্রত্যাশিত।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এ পূজার মাহাত্ম্য অশেষ। এ পূজা উপলক্ষ্যে কত মানুষ যে বিভিন্ন উপায়ে উপকৃত হয়, তার শেষ নেই। ঢাকাী, মালী, তাঁতী, পসারী, ময়রা, কামার-কুমোর, মৃৎ শিল্পী এরা বিশাল ভাবে আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করে। বারো মাসে ফলদানকারী কলা গাছকে নব সাজে বধুরূপে সজ্জিত করে মায়ের সঙ্গী করা হয়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের উপাদান নব পত্রিকা এ পূজার উপকরণ। মায়ের সন্তান হিসেবে পতিতা থেকে রাজপাটের কেহই মায়ের আশির্বাদ বঞ্চিত হয়নি। শরৎকাল নীলিমার শোভায় অপরূপা। এ সময়েই মা দুর্গা কৈলাশ হতে মর্তে শুভাগমন করেন, মনুষ্য কুলকে পরম পরশে পুলকিত করতে। জগতে হীন বলের স্থান নেই। শুদ্ধ চিন্তাসহ অসুর রূপী রিপুকে দমন করার যে একটি পরিকাঠামো, এ প্রতীকে ফুটে ওঠে, তা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। শিল্প, সংস্কৃতি, বিদ্যা, ধনৈশ্বর্য, ক্ষাত্রশক্তির প্রণোদনা, সংসার জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পরিস্ফুট হয় দুর্গা প্রতিমার সৃজনশীল কাঠামোতে।মানুষ সুন্দরের পূজারী। তাই এমন একটি ধর্মীয় শিল্প কর্মের মধ্যে সত্য সুন্দর ঈশ্বরকে ভাবতে বা চিন্তা করতে আনন্দ পাওয়া যায়। পরমা প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরিবেশে, মা দুর্গা প্রতিবছর ভক্তকুলকে কৃপা প্রদর্শন করতে, বছরের এমন সময়ে বিশেষ রূপে আবির্ভূতা হন। এ জগতটা একটা মস্ত পরিবার। মানুষ, জীব-জন্তু, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-তারা আরো কত কি মিলে। দেবী দুর্গাও একটি সমন্বিত পরিকাঠামোয় মর্তে শুভাগমন করেন। সকল কিছু সুষ্ঠু, সুন্দর, সুচারুরূপে চালিত হোক এটি সকলের চাওয়া। দুর্গতি নাশিনী মা দুর্গা প্রকারান্তরে এ কাজটিই করেন জীব কুলকে সুখী-সুন্দর রাখতে। আমরা যেন শুদ্ধ চিন্তা চর্চার মাধ্যমে মায়ের কাছে প্রার্থনা করি, মা আমাদের মানুষ কর। মনের পশুত্ব আমাদেরকে অনেকাংশে অধোগামী করে রেখেছে। তোমার কৃপায় মনের এ পশুত্ব নাশ হোক। প্রত্যেকের মন যেন হয় দীপ্তিময়। মনের ধ্যান অধ্যাত্ম জীবনের দ্বার স্বরুপ। মা দুর্গাকে ধ্যানে, মননে আমাদের মনের মধ্যে যেন স্থাপন করি, তাহলে মায়ের কৃপা অনবরত আমাদের মধ্যে বর্ষিত হবে এবং মানব জনম সার্থক হবে।