২০২০-এ এক অন্য রকম রমজান দেখছে পৃথিবী। করোনাভাইরাস কভিড-১৯-এর কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর নানা সংকটের মধ্য দিয়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ফরজ রোজা পালন করছেন বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। কোরআন নাজিলের মাসে ত্রিশ রোজা পালনের পাশাপাশি মুসলমানদের কাছে রমজান-ইবাদাতের অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে কোরআন তিলাওয়াত ও তারাবির খতমে কোরআন। তারাবির জামাতবদ্ধ বিশ রাকাত নামাজের মাধ্যমে হাফেজ সাহেবদের থেকে পূর্ণ কোরআন শুনে থাকেন রোজাদাররা। কিন্তু এবার ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় মসজিদের তারাবিতে খতমে কোরআন পড়া হচ্ছে না। এতে মুমিন বান্দাদের কোরআন শুনতে না পারার অতৃপ্তি থাকলেও অপূর্ণতার কিছু নেই। কারণ কোরআন এমন এক কিতাব, যার পড়া, শেখা, শেখানো ও আলোচনা সবই ফজিলতপূর্ণ। কোরআন তিলাওয়াত হলো সর্বোত্তম নফল ইবাদত। আর আল্লাহ তাআলা রমজানে নফলের মর্যাদা ও সাওয়াবের পরিমাণ বৃদ্ধি করে দেন।
এ মাসের একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরজ ইবাদতের সমপরিমাণ সাওয়াব। এবং এ মাসের একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ ইবাদতের সমপরিমাণ সাওয়াব।’ (সহিহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস : ৩১১৫)
তাই লকডাউনের অবসরে রমজানজুড়ে প্রতি ঘরে ঘরে হতে পারে কোরআন তিলাওয়াত ও প্রশিক্ষণের চর্চা। বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার ক্ষেত্রে এ সময় সরাসরি কোনো মাধ্যম না পেলে অনলাইনকেন্দ্রিক কোরআনের বিভিন্ন সাইট থেকেও সহযোগিতা নিতে পারি আমরা। একটু ইচ্ছা করলে বেশ কিছু সহজ আয়াত ও ছোট সুরাও মুখস্থ করা যাবে দীর্ঘ এ অবসরে।
নিম্নে কোরআনের তিলাওয়াত, শিক্ষা, আলোচনা ও আমল করার গুরুত্ব ও ফজিলত তুলে ধরছি।
রাসুল (সা.) রমজানে অধিক তিলাওয়াত করতেন:
রমজান কোরআন নাজিলের মাস। সংগত কারণেই অন্য মাসের চেয়ে এ মাসে কোরআন তিলাওয়াত বেশি করা প্রয়োজন। স্বয়ং রাসুল (সা.) রমজানে অধিক পরিমাণ তিলাওয়াত করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রমজান মাসের প্রতি রাতে জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট উপস্থিত হতেন এবং তাঁরা উভয়ই পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করে একে অপরকে শোনাতেন।’ (বুখারি, হাদিস : ৬)
তিলাওয়াতকারীর সাওয়াবের পরিমাণ:
তিলাওয়াতকারী প্রতি অক্ষরে দশ নেকি করে পায়। রমজানের বরকতে এ নেকি দ্বিগুণ, বহুগুণও বেড়ে যেতে পারে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি অক্ষর তিলাওয়াত করল তার বিনিময়ে সে একটি নেকি পাবে, আর একটি নেকির বিনিময় হবে দশ গুণ। এ কথা বলছি না যে আলিফ-লাম-মিম একটি অক্ষর বরং আলিফ একটি অক্ষর, লাম একটি অক্ষর, মিম একটি অক্ষর। (তিরমিজি, হাদিস : ২৯১০)
তিলাওয়াতকারীর প্রতি ঈর্ষা করা বৈধ:
হিংসা করা শরিয়তে নিন্দনীয় ও অবৈধ। কিন্তু যারা কোরআন তিলাওয়াত করে তাদের প্রতি ঈর্ষা বৈধ। অন্যের অধিক তিলাওয়াতের আমল দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজে বেশি তিলাওয়াতের সংকল্প করাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুই ব্যক্তির প্রতি হিংসা করা বৈধ—(১) ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ তাআলা কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন আর সে তা দিন-রাত তিলাওয়াত করে আর তার প্রতিবেশী তা শুনে বলে—হায়! আমাকেও যদি এভাবে কোরআন মাজিদ শেখানো হতো যেমন তাকে শেখানো হয়েছে, তাহলে আমিও এভাবে কোরআন তিলাওয়াত করতাম, (২) ওই ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তাআলা সম্পদ দিয়েছেন আর সে ওই সম্পদ মহান আল্লাহর পথে ব্যয় করতে থাকে, আর তার প্রতিবেশী তা দেখে বলে—হায়! আমাকেও যদি তার মতো সম্পদ দেওয়া হতো যেমন তাকে দেওয়া হয়েছে, তাহলে আমিও তার মতো আল্লাহর পথে ব্যয় করতাম, যেমন সে করছে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০২৬)
শুদ্ধ করার চেষ্টায় ঠেকে ঠেকে তিলাওয়াতকারীর সাওয়াব দ্বিগুণ:
যারা শুদ্ধ কোরআন পড়তে জানে না, তারা তিলাওয়াতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। শুদ্ধ করার পাশাপাশি ঠেকে ঠেকে হলেও তিলাওয়াত চালিয়ে যাওয়া উচিত। এতেও দ্বিগুণ সাওয়াবের কথা হাদিসে এসেছে।
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোরআন তিলাওয়াত পারদর্শী ব্যক্তিরা সম্মানিত ফেরেশতাগণের সঙ্গে থাকবে। আর যারা ঠেকে ঠেকে কষ্ট করে কোরআন তিলাওয়াত করে তারা দ্বিগুণ সাওয়াব পাবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৮৯৮)
রাত্রিকালীন যত বেশি তিলাওয়াত তত বেশি মর্যাদা:
রাত্রিকালীন নফল ইবাদত আল্লাহর নিকট অনেক প্রিয়। তাই আল্লাহ তাআলা রাতের সময়ে কোরআন তিলাওয়াতের আয়াত সংখ্যার পরিমাণ অনুযায়ী তিলাওয়াতকারীর মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতে দশটি আয়াত তিলাওয়াত করে সে গাফেল বলে গণ্য হবে না, আর যে ব্যক্তি এক শ আয়াত তিলাওয়াত করে সে আনুগত্যশীল বলে গণ্য হবে, আর যে ব্যক্তি এক হাজার আয়াত তিলাওয়াত করে তার জন্য সাওয়াবের ভাণ্ডার লেখা হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪০০)
কোরআনের তিলাওয়াতকারী আল্লাহর পরিজন:
কোরআন আল্লাহর কালাম তথা বাণী। আল্লাহর কালামের অধিক তিলাওয়াতকারীকে (সম্মানসূচক) আল্লাহর পরিবার ও বিশেষ বান্দা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কতক লোক আল্লাহর পরিজন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তিলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৫)
কোরআন অনুযায়ী আমলকারীর পিতা–মাতাকে সম্মানিত করা হবে:
কোরআন তিলাওয়াতকারী ও তদনুযায়ী আমলকারীকে আল্লাহ সর্বোত্তম পুরস্কারে ভূষিত করবেন। সেই সঙ্গে তার পিতা-মাতাকেও কিয়ামতের দিন সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল নূরের মুকুট পরাবেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে এবং তদনুযায়ী আমল করে, কিয়ামতের দিন তার পিতা-মাতাকে এমন মুকুট পরানো হবে, যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল হবে। ধরে নাও, যদি সূর্য তোমাদের ঘরে বিদ্যমান থাকে (তাহলে তার আলো কিরূপ হবে?)। তাহলে যে ব্যক্তি কোরআন অনুযায়ী আমল করে তার ব্যাপারটি কেমন হবে, তোমরা ধারণা করো তো! (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৫৩)
কোরআন শেখা ও শেখানোর মর্যাদা:
আল্লাহর কোরআন পৃথিবীর সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ কিতাব। এ সম্মানিত কিতাব যে শিখবে এবং শেখাবে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাকে সর্বোত্তম ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম যে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়।’ (বুখারি, হাদিস : ৫০২৭)
কোরআনের আলোচনায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়:
কোরআনুল কারিমের বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক আলোচনা-পর্যালোচনা করা কিংবা ঘরে কোরআন শেখা বা শেখানোর বৈঠক করা, এতেও রয়েছে অনেক সাওয়াব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায় যদি আল্লাহর কোনো ঘরে একত্র হয়ে কোরআন তিলাওয়াত করে এবং তা পরস্পরে শেখে, তবে তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল হয়; আল্লাহর রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে। আর আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছের ফেরেশতাদের সামনে তাদের কথা আলোচনা করেন।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৭৪৮)
আল্লাহ আমাদের কোরআনের তাৎপর্য ও ফজিলত উপলব্ধি করে রমজানজুড়ে বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করার তাওফিক দান করুন। সূত্র: কালেরকন্ঠ