
* নাশকতাকারীদের অগ্রাধিকার, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার উপেক্ষিত;
* নিয়োগ বাতিলের দাবিতে ইউএনও বরাবর আ’লীগ নেতাকর্মীদের চিঠি
নিজস্ব প্রতিবেদক: নৌকার বিরুদ্ধে জয়লাভের পর থেকে বিভিন্নভাবে ইউনিয়ন পরিষদের মানুষদের হয়রানির করে অর্থ আদায়ের অভিযোগের পর এবার গ্রাম পুলিশ নিয়োগে বেশুমার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠেছে জনপ্রতি ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী গ্রামের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, ইউনিয়ন পরিষদের কাজে সহযোগীতা, খাজনা ট্যাক্স, জন্ম ও মৃত্যু তথ্য প্রদান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহযোগীতা সহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম পুলিশ নিয়োগ দেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদ আইনের তপশীল-১ এ গ্রাম পুলিশ নিয়োগের বিধিমালা উল্লেখ আছে। ইউনিয়ন পরিষদ আইনে গ্রাম পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির পূর্ব কার্যকলাপ নেতিবাচক হলে তিনি নিয়োগের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বিবেচিত হবেন না বলা থাকলেও ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে তা উপেক্ষা করা হয়েছে। এমনকি নিয়োগের ক্ষেত্রে মৃত বা অবসরপ্রাপ্ত গ্রাম পুলিশের পুত্র, কন্যা বা পোষ্যদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা স্থানীয় সরকার আইনে উল্লেখ থাকলেও সাবেক গ্রামপুলিশের পুত্রকে বাদ দিয়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর ) নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ও সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাতেমা তুজ জোহরা স্বাক্ষরিত এক পত্রে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ন প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোন মামলা আছে আছে কিনা তা জানতে চেয়ে সাতক্ষীরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবর চিঠিও দিয়েছেন ইউএনও।
সরেজমিনে দেখা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৪ নং ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ নিয়োগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা সহ সকল ধাপে উত্তীর্ণ হওয়া স্বত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে স্বাধীনতা বিরোধী (জামায়াত) পরিবারের সদস্য সহ নাশকতা ও ফৌজদারী মামলার আসামীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ আছে এসব নিয়োগে মোটা অংকের অর্থ গোপনে লেনদেন হয়েছে।
ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ পদে নাসিরউদ্দীন পরানের পৌত্র সেলিম রেজা আবেদন করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও সেলিম রেজাকে নিয়োগ না দিয়ে জামায়াত পরিবারের সদস্য মানিক সরদারের পুত্র মোবাস্বির কে নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। মোবাস্বিরের চাচা আদর আলী ও চাচাতো ভাই তরিকুল একাধিকবার নাশকতা মামলায় জেল হাজতে ছিল। এমনকি তার পুরো পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত।
৫ নং ওয়ার্ডে ফৌজদারী মামলার আসামী শাহিনুরকে নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। সে জিআর ৭২০২/২২ নং মামলার চার্জশীট ভুক্ত আসামী।
একই ভাবে ৬ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ নিয়োগে বীর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী মোড়লের নাতনি মুক্তা খাতুন কে বাদ দিয়ে জামায়াত নেতা ইলিয়াস সরদারের পুত্র জামায়াত কর্মী মোঃ আঃ রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ ২০১৩-১৪ সালে জামায়াতের নাশকতার সময় আঃ রহমান ও তার পিতা ইলিয়াস সরদারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। তৎকালীন সময়ে তাদের জামায়াতের মিছিলে ও সহিংসতায় অংশগ্রহণের ছবিও এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে সংরক্ষিত আছে।
অর্থ ও স্বজনপ্রীতির বিনিময়ে জামায়াত সমর্থিতদের নিয়োগ দেওয়া ছাড়াও ইতোপূর্বে ইউনিয়ন পরিষদে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছে এবং পিতা সাবেক চৌকিদার থাকা স্বত্ত্বেও অনেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাননি। সেখানে অর্থের বিনিময়ে ফৌজদারী মামলার আসামী সহ বিতর্কিত ব্যক্তিরা নিয়োগ পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সুত্র জানায় এসব নিয়োগের জন্য গোপনে মাথাপিছু ১০ লক্ষ টাকা লেনদেন হয়েছে। ইউনিয়নের ১, ৩, ৫, ৬ ও ৯ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ নিয়েগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ৯ নং ওয়ার্ড বাদে বাকী সকল ওয়ার্ডেই বিতর্কিতদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে এলাকার মুক্তিয়োদ্ধা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ অভিযোগ করেন।
রবিবার (২০ নভেম্বর) অর্থের বিনিময়ে জামায়াত কর্মী ও ফৌজদারী মামলার আসামীদের বাদ দিয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের নিয়োগের দাবিতে ঘোনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ফজলুর রহমান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সহ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যৌথ স্বাক্ষর সংবলিত চিঠি সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা পুলিশ সুপার বরাবর জমা দেওয়া হয়েছে।
ঘোনা ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও গ্রাম পুলিশ নিয়োগের অন্যতম প্রার্থী আঃ সালামের পুত্র সেলিম রেজা সাতনদীকে বলেন, আমার দাদা নাসিরউদ্দীন পরান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের আমার কাছ থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তিনি আরো ২ লক্ষ টাকা দাবি করে। আমি আর টাকা দিতে না পারায় আমাকে নিয়োগ না দিয়ে জামায়াত পরিবারের সদস্য মোবাস্বিরকে ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানতে পারছি।
একইভাবে ৬ নং ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ নিয়োগের প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “আমি বিগত ৫ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করছি। করোনা মহামারীর সময়েও কাজ করেছি। আমি সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ন হই। নিয়োগের ব্যাপারে আমার অগ্রাধিকার থাকলেও আমাকে নিয়োগ না দিয়ে জামায়াত ক্যাডারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি তার নিয়োগ বাতিলের জোর দাবি জানাই।”
একই ওয়ার্ডের অপর প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস আলী মোড়লের নাতনি মুক্তা খাতুন সাতনদীকে জানান, “আমার নানা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিয়োগের ক্ষেত্রে আমার অগ্রাধিকার থাকলেও আমাকে নিয়োগ না দিয়ে জামায়াত কর্মী আঃ রহমানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি বিষয়টি চেয়ারম্যান আব্দুল কাদেরের কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন তোমরা গত নির্বাচনে আমার পক্ষে কাজ না করে নৌকার পক্ষে কাজ করেছো ফলে তোমাকে নিয়োগ দিব না।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বর খলিলুর রহমান বলেন, আমার ওয়ার্ডে গ্রাম পুলিশ হিসাবে মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন পরানের পৌত্র সেলিম রেজাকে নিয়োগ দেওয়া হবে বলে চেয়ারম্যান জানান। কিন্তু পরবর্তীতে আমি জানতে পারি সে পদে জামায়াতের নাশকতা মামলার আসামী পরিবারের মোবাস্বিরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক ও ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা এরশাদ আলী বলেন, মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দীন পরান ও আমরা একসাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। আওয়ামী লীগের ক্রান্তিকালে তিনি ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। গ্রাম পুলিশ নিয়োগে তার পুতা সেলিম কে নিয়োগ না দিয়ে জামায়াত পরিবারের সদস্য মোবাস্বিরকে নিয়োগের জন্য মনোনীত করায় আমরা হতাশ হয়েছি। আমরা অবিলম্বে জামায়াত পরিবারের সদস্যদের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক ক্ষতি হবে।
গ্রাম পুলিশ নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঘোনা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ফজলুর রহমান মুসা বলেন, “গ্রাম পুলিশে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের বাদ দিয়ে জামায়াত পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এমন বিতর্কিতদের নিয়োগের জন্য মনোনীত করেছেন। এমনকি স্থানীয় সরকার আইনকে অমান্য করে বিতর্কিতদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি অবিলম্বে এমন বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করে উপযুক্ত ব্যক্তি ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
অভিযোগ অস্বীকার করে ঘোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের সাতনদীকে জানান, “আমি চেয়ারম্যান হিসাবে পদাধিকার বলে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলাম। যারা স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। আমি নিজে কারো কাছ থেকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে কোন টাকা পয়সা নেই নি। নিয়োগ বোর্ডের অন্য কেউ নিয়োগ বানিজ্য করেছে কিনা আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিয়োগ বোর্ডের প্রধান ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা সাতনদীকে জানান, “আমরা এখনো কাউকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেই নি। মৌখিক পরীক্ষায় প্রাথমিক ভাবে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করেছি। পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আসলে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হবে। অর্থ বানিজ্য বা অনিয়মের বিষটি আমার জানা নেই। আমি এখনো লিখিত অভিযোগের কপি হাতে পাই নি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।