
বন্দে মাতরম! মাকে বন্দনা করি! এই মা আমাদের জন্মভূমি। আমাদের মাতৃভূমি তৎকালীন ভারতবর্ষ। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেছেন এই মহামন্ত্র। তিনিই প্রথম শিখিয়েছেন দেশের মাটিকে মা বলে চিনতে। নিজেদেরকে দেশমাতার সন্তান বলে পরিচয় দিতে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা তৎকালীন ভারতভূমি। বিদেশি বণিক শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত পরাধীন ভারতভূমি সেই থেকে আমাদের মা। কোটি কোটি ভারতবাসীর মুখে দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়েছে মাতৃবন্দনার এই পবিত্র মন্ত্র- বন্দে মাতরম! ১৯০৫ সাল ১৬ অক্টোবর, কুখ্যাত বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে ভেঙে দু’টুকরা করে দিলেন। দুর্বল করে দিতে চাইলেন বাঙালির ভিত। কন্ঠরোধ করা অত সহজ নয়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে গর্জে উঠলো সারাদেশ। শোকদিবস হিসেবে ঘরে ঘরে পালিত হতে শুরু করল। চারদিকে শুরুহলো ধর্মঘট। রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন রাখী বন্ধন উৎসব। হাটে বাজারে মাঠে ময়দানে মিটিং মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় তুললেন দেশের নেতৃবৃন্দ। বিদেশি জিনিস বর্জনের সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। দোকানে দোকানে শুরুহলো পিকেটিং যাতে দোকানদারেরা বিদেশি জিনিস বেচতে না পারে এবং কেউ কিনতে না পারে। দেশের নির্ভীক তরুণ ছাত্রসমাজ সবার আগে এগিয়ে এলো এই কাজে। সারা মেদিনীপুরও তখন অগ্নিগর্ভ। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে তৈরি হলো বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ক্ষুদিরাম সেখানে সবার অগ্রণী। মেদিনীপুরে দশহাজার মানুষের বিরাট মিছিল বেরোল। ভিখিরি থেকে জমিদার সবাই মিলেÑ তার পুরোভাগে ক্ষুদিরাম। স্থানীয় ছাত্র ও যুবকরা শপথ নিলেন বিলিতি জিনিস তারা ব্যবহার করবে না। বিপ্লবী হেমচন্দ্রের কাছ থেকে ক্ষুদিরাম হঠাৎ রিভলবার চেয়ে বসে। তখন ক্ষুদিরামের বয়স আনুমানিক চৌদ্দবছর হবে। হেমচন্দ্রের জিজ্ঞাসায় ক্ষুদিরাম বলেছিল ‘সাহেব মারবে’ সাহেব মারার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে খুব উত্তেজিত হয়ে যা বলেছিল, তা অবাক হওয়ার মত। এককথায় ক্ষুদিরামের ভাবছিল ভারতের উপর ইংরেজরা যে অন্যায় অত্যাচার করছে, তার প্রতিশোধ তাকে নিতেই হবে। একবার সোনার বাংলা নামে ইংরেজ বিরোধী এক প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে পুলিশের চোখে পড়েন। পুলিশকে ঘুষি মেরে ক্ষুদিরাম পালিয়ে যায়। কিন্তু এতে ক্ষুদিরামে বিরুদ্ধে ১২১ ও ১২৪ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হয়। মামলা হওয়ার পর ক্ষুদিরাম নিজেই থানায় আত্মসমর্পণ করলেন। পুলিশ তার উপর অত্যাচার চালিয়েছে কিন্তু ক্ষুদিরাম কোন কথা প্রকাশ করেন নি। ক্ষুদিরামই বাংলার সেই প্রথম বিপ্লবী যাঁর বিরুদ্ধে ইংরেজ সরকার প্রথম রাজদ্রোহের মামলা দায়ের করেছিলেন। জেল হাজতে নিক্ষেপ করা হয় ক্ষুদিরামকে। জেলা জজ র্যানসমের আদালতে আরম্ভ হয় ক্ষুদিরামের বিচার। ক্ষুদিরামের পক্ষের উকিল যখন জামিনের জন্য দরখাস্ত করেন। ক্ষুদিরাম তখন উকিলকে বলেছিলেন, আমার জন্য মিথ্যা সময় নষ্ট করছেন কেন? আমি তো শাস্তি এড়াতে চাই না। আমি চাই এরা আমাকে জেলে ভরুক। জেলে না গেলে ফাঁসিতে না ঝুললে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করব কি করে? দেশের কাজ ছাড়া ক্ষুদিরাম যেন আর কিছু ভাবতে পারেন না। দেশই তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। ভাইকে সামলাতে না পেরে দিদি অপরূপা একবার চেষ্টা করছিল বিয়ে দিতে। একবার পাত্রী দেখাতেও নিয়ে গিয়েছিলেন ক্ষুদিরামকে। কিন্তু কোন লাভ হলো না। ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, সাদা পঙ্গপালগুলোকে আগে তাড়াই দেশ থেকে। তারপর তোমার কথামত বিয়ে করব। সাদা পঙ্গপালগুলো শুষে শুষে খাচ্ছে দেশটাকে। ঐ ফিরিঙ্গিগুলো তাদের মিলে কাপড়ে দেয়ার জন্য দেশের ধান চাল সব সমুদ্রপথে চালান করে দিচ্ছে জাহাজে বোঝাই করে। তাই তো পেট ভরে খেতে পাচ্ছে না আমাদের দেশের মানুষ। ইতিহাসকুখ্যাত অমানুষ মিঃ কিংসফোর্ড কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট। সেই যেমন ছিল অমানুষ তেমনি ছিল হৃদয়হীন। ব্রিটিশ সরকারের সম্রাজ্যবাদী অত্যাচারের এক জীবন্ত প্রতিমূর্তি যেন। বাঙালিদের উপর তাঁর তীব্র বিদ্বেষ স্বদেশি আন্দোলনকে দমন করতে তিনি যথেষ্ট অত্যাচার করেছিলেন। প্রাণদন্ডের দন্ডিত আসামি কিংসফোর্ডের জীবন মরণ দুটি বাঙালি কিশোরের হাতে! কিন্তু কিংসফোর্ড তখন কলকাতা থেকে বদলি হয়ে মজঃফরপুরের জেলা জজ হিসেবে চলে গেলেন। এপ্রিলে এক সন্ধ্যার অন্ধকারে যাত্রা শুরুদুই তরুণের। তাদের হাতে গ্যাডস্টোনের ব্যাগের মধ্যে লুকানো আছে কিংসফোর্ডের মারণাস্ত্রÑ একটি টিনের বাক্সে কাপড়ে মোড়া মারাত্মক বোমা। এছাড়াও তাদের প্রত্যেককে রিভলভার দেয়া হয়েছে। কোন কারণে ধরা পড়ার উপক্রম হলে আত্মহত্যা করতে দ্বিধা করবে না তাঁরা। ঐ বিশেষ বোমাটি তৈরি করেছিল হেমচন্দ্র কানুনগো এবং উল্লাসকর দত্ত। ইংরেজদের সশস্ত্র অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের পথই বেছে নিয়েছিলেন অগ্নিযুগের এই মহা বিপ্লবীরা। বোমা স্পিøন্ট আর রিভলবারই ছিল তাদের হাতিয়ার। ক্ষুদিরামের বিবরণ মতে মজঃফরপুর গিয়ে এক ধর্মশালাই অবস্থাকালীন কিংসফোর্ডে বাড়ির গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিল।