এফএম শরিফুল ইসলাম
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটির দীর্ঘ পথ চলায় রয়েছে দেশ ও জাতির জন্য গৌরবময় অসংখ্য অর্জন। সমৃদ্ধ সেসব অর্জন জাতিকে দিয়েছে নতুন পথের ঠিকানা। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে কোন কাজ করতে চাইলে অধিকাংশ সময় সে যাত্রা ছাত্রলীগ দিয়ে শুরু করতেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন ছাত্র নেতাদের চিঠি লিখে আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে দিকনির্দেশন দিতেন। বলা যায় ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং তাদের সংগঠিত করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তিনি ছাত্রলীগকে প্রাধান্য দিতেন।
দেশের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ১৭ হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, তথাকথিত ১/১১ সেনাসমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ইতিহাসের সবখানেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছে। গর্বের সঙ্গে বলা যায় যে কোন সঙ্কটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রয়েছে অনন্য অবদান। স্বৈরশাসক মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রের প্রবর্তন করেন। তিনি ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এ দেশের মেধাবী শ্রেণীকে বিপথগামী করে তোলেন। সেখান থেকে ছাত্রবান্ধব নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর মতিঝিল শাপলা চত্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পুনর্মিলনীতে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার হাতে বই, খাতা ও কলম তুলে দিয়ে আবারও ইতিবাচক ধারায় বাংলার ছাত্র সমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে নিয়ে আসেন। ছাত্ররাজনীতিতে বলা যায় এক নবযুগের স‚চনা এবং মেধাবী ধারা প্রবর্তন করেন দেশরতœ শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় দিকনির্দেশনা ও উপদেশ দিয়ে থাকেন। তার মধ্যে উলেখযোগ্য হলো ‘শুধু ভাল কর্মী হলে চলবে না, ভাল ছাত্র হতে হবে’ যা প্রমাণ করে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক এবং মেধাবী রাজনীতির পথ দেখিয়েছেন তিনি। অস্ত্র নয় কলমের শক্তির প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সবসময়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’, ‘দেশ গড়ার জন্য সোনার ছেলে চাই। সেই সোনার ছেলে গড়ার কারিগর ছাত্রলীগ।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম। জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল জর্জরিত। যার যৌবনের ১৩টি বছর কেটেছে পাকিস্তান কারাগারে। ১৯৬৯ সালে ২১ দফা আন্দোলনের ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জেল থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে বক্তৃতা করে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন কর্মের সঙ্গে তাই ছাত্রলীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত এটি চিরন্তন সত্য।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন নিজের প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে ছাত্রদের মাঝে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ছাত্রসমজের কাছে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ধারণা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এসেছে। ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে এই উপলব্ধি থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার বয়স সীমা ২৭ বছর নির্ধারণ করে দেন, যা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র সমাজের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিচালিত হয়ে থাকে। ২০০১ সালের ১৭ মে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি বাহাদুর বেপারী ও সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দেশরতœ’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। এটি প্রমাণ করে ছাত্রলীগ সময়ের প্রয়োজনে তার অভিভাবককে ম‚ল্যায়ন করতে ভুলে যায়নি।
ইতিহাস বলে প্রয়োজনে দেশের যে কোন সঙ্কটকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার সর্বোচ্চ দিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভ‚মিকা ছিল অনবদ্য। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রদল ও শিবিরের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, অছাত্রদের সংগঠন ছাত্রদল ও রগ কাটা বাহিনী ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয় আনে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার অবৈধভাবে সরকার গঠন করে সেই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এ সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হয। জেল-জুলুম, হুলিয়া দিয়ে ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার ১৪ জানুয়ারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
২৭ জুলাই ২০০৭ দিনটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এক কালো দিন। তত্ত¡াবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বাংলা ও বাঙালীর প্রিয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সুধাসদন থেকে যৌথবাহিনী দ্বারা গ্রেফতার করে। নেত্রীর মুক্তির দাবি করে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে কোর্টের সামনের রাস্তা অবরোধ করে। সেদিনের মিছিল আলোড়ন সৃষ্টি ও শাসকগোষ্ঠীর মাঝে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। বাংলার গণতান্ত্রিকামী মানুষের প্রবল চাপে ও আন্দোলনের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিনের তত্ত¡াবধায়ক সরকার, যার অবদান নিশ্চয় ছাত্রলীগকে দিতে হয়। এছাড়া সে সময় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিশেষ ভ‚মিকা পালন করে।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সারা বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সেভ ক্যাম্পাস ক্লিন ক্যাম্পাস’ কর্মস‚চী ঘোষণা করে। ‘সেভ ক্যম্পাস ক্লিন ক্যম্পাস’ কর্মস‚চীর মাধ্যমে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক কর্মস‚চীতে যুক্ত করেন সজিব ওয়াজেদ জয়। যা নতুন করে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ছাত্রলীগকে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়।
স‚র্যের আলোর মতো তেজদীপ্ত হয়ে গণমানুষের অধিকার আদায়ে নিয়মিত রাজপথে সোচ্চার এবং ছাত্রসমাজের অভিভাবক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র সমাজের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাবে নিরন্তর, সে প্রত্যাশা রইল। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবময় ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের শুভাকাক্সক্ষী এবং অসংখ্য নেতাকর্মীদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা।
লেখক : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ