স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, একাত্তরে ময়মনসিংহ শহরের ছোট বাজার কুয়ার ভেতরে পড়ে ছিল অসংখ্য নারী পুরুষ ও শিশুর পচা এবং অর্ধগলিত লাশ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর মদতে ও প্রশ্রয়ে রাজাকার আলবদর ও অবাঙালি বিহারি হায়েনারা মুক্তিকামী বাঙালিদের ধরে এনে বীভৎস নির্যাতন করে হত্যার পর তাদের লাশ ফেলে দিতো ছোট বাজারের এই কুয়ার ভেতরে। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধা জনতা যখন শহরজুড়ে হারানো স্বজনদের খুঁজতে বের হন, তখনই সন্ধান মেলে এই কুয়ার ভেতরে অসংখ্য লাশ স্তূপাকারে পড়ে থাকা এই বধ্যভূমিটির। অথচ সংরক্ষণ না করে ভয়াল স্মৃতির সেই কুয়ার চিহ্নটি মুছে ফেলা হয়েছে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক জানান, বধ্যভূমির সেই কুয়ার ওপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের ভবন। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ আমলে এই বধ্যভূমির ওপর সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড, ময়মনসিংহ থেকে স্থানীয় জেলা প্রশাসনের কাছে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে আবেদন জানানো হয়েছিল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জায়গাটি উদ্ধারের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে শহরে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। তারপরও এ নিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি জানান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল অভিযোগ করে জানান, শহরের ছোট বাজারস্থ বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক, ময়মনসিংহ শাখা ভবনটির বর্তমান স্থলে ছিল একাত্তরের বধ্যভূমি। একাত্তরে স্থানীয় রাজাকার ও আলবদররা বাসা থেকে হাসপাতালে যাওয়ার পথে শহরের গাঙিনাপাড় এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যায় রতন খন্দকারকে। আলবদরদের আস্তানা শহরের ডাকবাংলো, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাক সেনাদের নানান আস্তানায় খুঁজেও ভাইয়ের কোনও সন্ধান পাননি তার ছোট বোন শেফালি খন্দকার। একাত্তরের ১০ ডিসেম্বরে ময়মনসিংহ মুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধা জনতার সঙ্গে সেদিন শেফালী খন্দকারও ভাই রতনের লাশ খুঁজতে বের হন।
শেফালি খন্দকার জানান, ডাকবাংলো ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসে ভাইয়ের লাশ না পেয়ে শহরের ছোট বাজারের কুয়া দেখতে গিয়েছিলাম। কুয়ার ভেতরে নারী পুরুষের গলিত, অর্ধগলিত পচা অসংখ্য লাশ দেখা গেলেও ভাইয়ের লাশ পাইনি। কুয়ার চারপাশজুড়ে তখনও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে ছিল। ব্লাউজ, পেটিকোট ও শাড়ি ছিল স্তূপাকারে কুয়ার ভেতরে, জানান শেফালি।
মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে নারী ও শিশুদের ধরে এনে ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতন করে তাদের হত্যা করতো আলবদর রাজাকাররা। এরপর এই কুয়ার ভেতরে পোশাকসহ তাদের মরদেহ ফেলে দিতো।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আব্দুর রব আক্ষেপ করে জানান, আশির দশকেও কুয়াটি ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদে জায়গাটির মালিকানা বদল হলে ওই জমিতে ইসলামী ব্যাংকের ময়মনসিংহ শাখার ভবন নির্মাণ করা হয়। এতে সেই কুয়ার বধ্যভূমিটি চাপা পড়ে। বধ্যভূমিটি সংরক্ষণের জন্য দুইবার এই জায়গায় সাইনবোর্ড ঝোলানো হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ করার আবেদনও করা হয়েছিল। তবে কোনও আবেদন নিবেদনে কাজ হয়নি। প্রশাসনেরও সাড়া মেলেনি। ফলে বধ্যভূমির স্মৃতিচিহ্ন মুছে এর ওপর ইসলামী ব্যাংক ভবন করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ খান পাঠান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, স্থানীয় প্রশাসন বধ্যভূমির জায়গাটি খালি করে দিলে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে এর উন্নয়নে কাজ করবেন তারা।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ময়মনসিংহ শাখার ব্যবস্থাপক মো. গোলাম মোস্তফা জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জানতে হবে। তিনি যোগদানের পর এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে কেউ কোনও কথা বলেনি।
এদিকে, জেলা শহরে আছে আরও বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি। এরমধ্যে মহানগরীর ডাকবাংলোর পেছনে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্টহাউসের পেছনে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন পার্কের বধ্যভূমিসহ জেলার মুক্তাগাছার মানকোন বিনোদবাড়ি, গফরগাঁওয়ের চরআলগী, ফুলপুরের সরচাপুর বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
সুত্র বাংলা ট্রিবিউন