
শত শত বছর পরে কোনো জাতির মধ্যে এমন একজন মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমন একজন বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা। তিনি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের এক মহানায়ক, তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা।
বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবন। সেই জীবনের তিনটি প্রধান পর্যায়। ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ তার জীবনের প্রথম পর্যায়। সেটি তার রাজনৈতিক জীবনের প্রস্তুতিকাল। তখন তিনি ছিলেন হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্ত কর্মী দলের একজন সদস্য। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০। এই সময়ে তার ভূমিকা একজন বলিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী নেতার। তৃতীয় পর্যায় ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫, যখন তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা, এবং রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার জীবন পায় পূর্ণতা।
গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শৈশবেই লক্ষ করেছেন এই ভূখণ্ডের কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমার, সাধারণ মানুষ শোষিত, বঞ্চিত ও অত্যাচারিত। অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান, তবে শোষণ-বঞ্চনার শিকার সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ। বিশেষ করে জমিদারি ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। মুসলিম লীগ পাকিস্তান আন্দোলন শুরু করলে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি আশার সঞ্চার হয়—তাদের শত শত বছরের শোষণ-নিপীড়নের অবসান হবে। তরুণ শেখ মুজিব সেই আন্দোলনকে সমর্থন দেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনি সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই তখনকার অসাম্প্রদায়িক প্রগতিবাদী তরুণ নেতাদের মতো শেখ মুজিবেরও প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তান হবে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পরপরই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শাসকশ্রেণির স্বেচ্ছাচারী চরিত্রের নগ্ন প্রকাশ ঘটে। রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলার প্রতি শাসকশ্রেণির অবহেলায় ছাত্র ও যুবসমাজ প্রতিবাদে রাজপথে নামে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তানে শুরু হয় বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন। সেই আন্দোলনের নেতাদের একজন ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে চরম প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ধারণ করে। তার নেতাদের গণতন্ত্রের প্রতি কিছুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। তারা দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। ঐ অবস্থা নীরবে সহ্য করা বঙ্গবন্ধুর মতো তেজস্বী তরুণ নেতাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তারা মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।
ভাসানী, শেখ মুজিব ও শামসুল হক বলতে গেলে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে বাংলাদেশের সব এলাকা ঘুরে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সভা-সমাবেশ করে জনমত গঠন করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর নেমে আসে সরকারি নিপীড়ন। বারবার হন কারারুদ্ধ। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’
শত নিপীড়ন সত্ত্বেও বাংলার মানুষের স্বাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু অবিচল থাকেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে জোলানোর ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করে পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলা চক্র। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। সত্তরের নির্বাচনে বাংলার মানুষ তার নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করে। তিনি চেয়েছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, পাকিস্তানি শাসকেরা ব্যবহার করেছে অস্ত্র। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই আন্দোলন দমনে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যে গণহত্যা চালায়, পৃথিবীর ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। পাকিস্তানিরা তাকে বন্দি করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং প্রহসনমূলক বিচারের আয়োজন করে। কিন্তু তিনি ন্যায়ের পথে থাকায় বিশ্বজনমত তার পক্ষে থাকে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। পৃথিবীর জনমতের চাপে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
বাহাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধু। সীমাহীন সমস্যা তখন দেশের। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তার সরকারের সাফল্য অসামান্য। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালানো হয়। সাধারণ মানুষের সমস্যা ও দুঃখ-কষ্টের কথা তার চেয়ে বেশি তার সরকারের আর কেউ বুঝতেন না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে স্থিতিশীল করতে এবং অর্থনীতিকে টেকসই করতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধুর দেশীয় ও বিদেশি শত্রুরা তাকে সেই সময়টি দিল না।
ঘাতকের হাতে পৈশাচিকভাবে নিহত না হলে তিনি তার আরাদ্ধ কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন এবং জাতি উপকৃত হতো। তার পরিবারের পূর্বপুরুষদের যে ইতিহাস, তাতে ধারণা করা যায়, তিনি তার আব্বা-আম্মার মতোই দীর্ঘায়ু হতেন। আরো অন্তত ২৫ বছর তিনি বাংলাদেশ পরিচালনা করতে পারতেন। তার শত্রুরা সেই সুযোগ থেকে জাতিকে বঞ্চিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু তার আদর্শের মৃত্যু নেই। শারীরিকভাবে তিনি আমাদের মধ্যে না থাকলেও তার আদর্শ রয়ে গেছে। সেই অসাম্প্রদায়িক আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক
সংগ্রহ : দৈনিক ইত্তেফাক।