
আমার বরাবরই অভ্যাস- অপরের প্রশংসা করা। জুনিয়রদের প্রশংসা করি- সে যেন আরো বেশি তৎপর হয়, কর্মকাণ্ডে যেন দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। পাশাপাশি সে নিজেও যেন অপরের ভালো অংশের সুনাম করতে শিখে। সহকর্মী, বন্ধুদের প্রশংসা করি- তারা যেন স্বীয় কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক স্বীকৃতি পেয়ে অপর বন্ধুদের প্রশংসা করার মানসিকতা গড়ে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার ১৭ সহস্রাধিক ফলোয়ার সমৃদ্ধ টাইম লাইনে যারই প্রশংসা করে কিছু লিখি তারই যেন হাম বড়া ভাব সৃষ্টি হয়। অপরের প্রশংসা করার মানসিকতা গড়ে ওঠা দূরের কথা, প্রথমেই সে আমাকে নিজের চেয়ে কম জানাশোনা, কম সম্মানী, তুচ্ছতায় পরিগণিত করতে চায়। পরক্ষণেই নিজেকে আকাশচুম্বী কিছু ভেবে নিতেও দ্বিধা করে না।
আমার সুদীর্ঘ সময়ের বন্ধু, মিডিয়া জগতে বেশ পরিচিত এক ভদ্রলোকের কথা বলি। আমি যখন তৎকালীন ডাকসাইটে গণমাধ্যম বাংলাবাজার পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টার, বর্ষসেরা সাংবাদিক হিসেবে পুরস্কার করি- তখনও তিনি আমারই বন্ধু মাহমুদ ইকবালের অধীনে ভোরের কাগজে অনিয়মিত প্রদায়ক হিসেবে কাজ করেন। ২০০৫ সালে দৈনিক সংবাদে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাই আমাকে ও দীপু সারোয়ারের সমন্বয়ে দেশে প্রথম অনুসন্ধানী রিপোর্টিং বিট ওপেন করেন। তার দুই বছর পর ভদ্রলোক আমার কাছে এসে ধরনা দিলেন তার জন্য অনুসন্ধানী বিট তৈরির একটি কাঠামো প্রস্তুত করে দিতে। যথারীতি রূপরেখা প্রণয়ন, কাজের ধরন ঠিক করা এমনকি কি রকম সংবাদ কর্মী নিয়ে অনুসন্ধানী বিটের টিম সাজানো যেতে পারে সেটিও ঠিক করে দিলাম। সবশেষে কর্মী বাছাইয়ে তার অপারগতার কারণে আমার নিজের গড়ে তোলা দুই নবিশ সাংবাদিককেও তার টিমে যুক্ত করিয়ে দিলাম।
কয়েক মাসেই চমৎকার সফলতা পেলেন এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাটিতে (এখন শীর্ষ পত্রিকার একটি) অনুসন্ধানী বিটটি ব্যাপক প্রশংসাও কুড়ালেন। যেই মাত্র আমি ওই সাংবাদিক বন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অনুসন্ধানী বিটের প্রশংসা করে কয়েক লাইন লিখলাম সাথে সাথে তার চেহারা মোবারক যেন পাল্টে গেল। তিনি নিজের টাইম লাইনে লিখে ফেললেন- দেশের গণমাধ্যমে তিনিই অনুসন্ধানী রিপোর্টিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা এবং সফলতা অর্জনকারী। তখন পর্যন্ত নাকি দেশে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং নিয়ে আলাদা বিট প্রতিষ্ঠার কথা মাথায়ও আনেনি কেউ। ,,,, ততোদিনে আরো দুটি মিডিয়ায় অনুসন্ধানী রিপোর্টিং বিট প্রতিষ্ঠা এবং সাড়া জাগানো রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে আমি অন্তত তিনটি পুরস্কারও জুটিয়ে নিয়েছি। অথচ সাংবাদিক বন্ধুটি নিজেকে অনুসন্ধানী রিপোর্টিং বিট প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে প্রচার করতে একটুও লজ্জা পাচ্ছেন না।
সংবাদে চাকরির এক বছরের মাথায় বুলবুল ভাই আমাকে সিটি ইনচার্জ বানিয়ে কাঁধে চাপিয়ে দেন দৈনিক আট পৃষ্ঠার নগর পাতা। পাতার যাবতীয় বিষয় আফাজউদ্দিন বিপ্লব ভাই দেখভাল করলেও আট পৃষ্ঠার জন্য প্রতিদিন নিজস্ব প্রতিবেদনের জোগান দিতে আমাকে হিমশিম খাওয়ার অবস্থায় পড়তে হতো। টিম মেম্বার হিসেবে পেয়েছিলাম রফিকুল ইসলাম মন্টু (উপকূলীয় সাংবাদিকতায় ভিন্নধারা উদ্ভাবনকারী), মোহাম্মদ ফয়সাল (বর্তমানে এস এ টিভির বার্তা সম্পাদক), প্রসূণ আশিস (বর্তমানে এনটিভিতে কর্মরত), রোজিনা ইসলাম (প্রথম আলোIJর স্পেশাল রিপোর্টার-ক্রাইম), নাহিদ তন্ময় তনু (সমকালের সাবেক সিনিয়র ক্রাইম রিপোর্টার), ভিএম আরিফ (সর্বশেষ যায়যায়দিন এর স্পেশাল রিপোর্টার), জাহাঙ্গীর শাহ কাজল (স্পেশাল রিপোর্টার- প্রথম আলো), ফখরুল হারুন (স্পেশাল রিপোর্টার- প্রথম আলো) কে।
সম্প্রতি আমার ওই টিমেরই একজন মেম্বারকে ভার্চুয়াল সাংবাদিক প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক হিসেবে বাছাই করি এবং সূচণাপর্বে আমি তার ভূয়সী প্রশংসা করে অত:পর প্রশিক্ষণ ক্লাশ পরিচালনার জন্য বলি। পুরো সেশনে ভদ্রলোক উলটো আমাকে তার ছাত্র বানাতেও দ্বিধা করেননি। আমার তো ছাত্র হতে আপত্তি নেই… কিন্তু তার কৃতজ্ঞ হতে বাধা কোথায় তা ভেবে পাই না।
এই তো কয়েকদিন আগেই হঠাৎ সম্পাদক হওয়া এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম দুটি কারণে। এক. তিনি অনেকবার ফোন করে তার সঙ্গে চা পানের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। দুই. পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থেকে আমার এক ভক্ত সাংবাদিক এসেছিলেন তার পত্রিকার প্রতিনিধি হতে চান। দুটি বিষয় মাথায় নিয়ে তার কাছে পৌঁছানোর পর ভদ্রলোক বেশ সমীহ করেই কথাবার্তা বলছিলেন।
যে-ই কিনা আমি তার সম্পাদক হওয়ার সাহসের দু‘লাইন প্রশংসা করেই যেন বিপাকে পড়লাম। আমার মুখে প্রশংসা শুনেই নয়া সম্পাদকের ভাবখানা আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো, পরের বাক্যটিই ছিল তার- “আমি সাংবাদিকতা ছেড়ে এখন কোন্ পেশায় গেছি?” এমন কথা শুনে আমার সম্পাদিত পত্রিকায় কাজ করা রিপোর্টার যুবকটি আর সেখানে বসে চা সেবনের প্রয়োজনবোধ করেনি, তার রুম থেকেই বেরিয়ে যায়। আমি শুধু ওই সম্পাদককে বলেছি, “রিপোর্টিংয়ে বরাবরই দুর্বল ছিলে জানতাম- ইদানীং কি পাঠক হিসেবেও দুর্বল হয়ে পড়েছো?”
তবে সহকর্মী, বন্ধুদের মর্যাদা দেওয়া, প্রশংসা করার চমৎকার মানসিকতা দেখতে পাই এটিএন বাংলার কেরামতউল্লাহ বিপ্লব ভাই, সাংবাদিক নেতা আবুজাফর সূর্য ভাই, মানবজমিনের যুগ্ম সম্পাদক শামীম ভাই, ডিআরইউ সভাপতি আবু সালেহ আকন, ক্র্যাব সভাপতি মির্জা মেহেদী তমাল, সাধারণ সম্পাদক এম এম বাদশাহ‘র মধ্যে।
সহকর্মীদের ভালো গুণের প্রশংসা আর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কুণ্ঠা নেই তাদের। কিন্তু বেশিরভাগ সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরা হাম বড়া ভাবের মধ্যে কী তৃপ্তি খুঁজে পান জানি না। আমি নিজেও আমার টাইম লাইনে সহসা কারো প্রশংসা করতে এখন ভয় পাই, ভাবি- ভালো লোকটাকে নষ্ট করার কি দরকার? একবার প্রশংসা পেলেই তো নিজে বখে যাবে, অন্যদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা শিখে যাবে। (এ তালিকায় আরো অনেকেই আছেন, আশা করি নিজেকে বদলে নেবেন, শুধরে যাবেন)