
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম:
দেশের মহামারী করোনা ভাইরাসের আক্রমণ ও আক্রান্তে সাধারণ মানুষ যখন দিশেহারা পবিত্র রমজান মাসের শেষের দিকে মহান আল্লাহর সৃষ্টি দূর্যোগ ঘূূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সৃষ্ট সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলা ও ক্ষতি এড়াতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থাগুলো। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। কক্সবাজারে মহেশখালী চকোরিয়া টেকনাফ, চট্টগ্রামে আনোয়ারা, বাঁশখালী, চট্টগ্রাম শহরের একাংশ। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে মাত্র ৩৭০ কিলোমিটার দূরে আছে আম্ফান। তবে তার শক্তি আগের অবস্থাতেই রয়েছে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২০০ থেকে ২২০ কিলোমিটার। এ অবস্থায় মোংলা ও পায়রার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে সংকেত বাড়ানো হয়েছে। সংবাদটি প্রেরণের আগপর্যন্ত ৬ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে। অন্যদিকে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসেরও পূর্বাভাস রয়েছে। মজুদ করা হয়েছে শুকনো খাবার। গঠন করা হয়েছে মেডিকেল টিম। এছাড়া নগরী ও উপকূলীয় উপজেলায় প্রস্তুত করা হয়েছে ৪ হাজার ৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র। এতে প্রায় চার লক্ষ লোক আশ্রয় নিতে পারবে। এর মধ্যে নগরীতে প্রস্তুতকৃত আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১১২টি। জেলা ও উপজেলায় গতকাল বিকাল পর্যন্ত এক হাজার ৭৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রায় ছয় হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও দাবি জেলা প্রশাসনের। অবশ্য গতকাল বিকালে দক্ষিণ কাট্টলী বাসন্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পতেঙ্গা ফুলছড়ি এলাকার আশ্রয়কেন্দ্রসহ নগরীর একাধিক আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে তালাবদ্ধ দেখা গেছে। তাছাড়া স্থানীয়দের মধ্যেও আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে অনীহা দেখা গেছে। এছাড়া ভারী বর্ষণ হলে পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকলেও নগরীর পাহাড়গুলোতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া হয়নি।
এদিকে গতকাল দিনভর উপকূলীয় এলাকায় জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন এবং সিএমপির পক্ষে মাইকিং করে সতর্ক করা হয়েছে। এসময় স্থানীয়দের সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। অবশ্য আজ বুধবার ভোর থেকে প্রশাসন হার্ডলাইনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রয়োজনে জোর করে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। আম্ফানকে ঘিরে প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ কামাল হোসেন দৈনিক সাতনদীকে বলেন, সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। চার হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছি। সেখানে চার লক্ষ লোক আশ্রয় নিতে পারবেন। ইতোমধ্যে ৫০ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া রেসকিউ টিম, মেডিকেল টিম ও ওষুধপত্রও প্রস্তুত করেছি। শুকনো খাবার প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে সামজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সেটা মাথায় রেখেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ওয়াশ রুম, পানি, লাইটসহ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
শহরে আশ্রয়কেন্দ্রে লোকজন না আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা এখনো কম বলে হয়তো অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চাচ্ছেন না। তবে সকালে আমরা কঠোর হব। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ সবার সহযোগিতায় জোর করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাব। তবে এটাও ঠিক, শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থা ভিন্ন। শহরে অনেকের আত্মীয়স্বজন আছে এবং তারা সেখানেও চলে যাচ্ছে।
সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন আম্ফানে ভীত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন, তাই আমাদের প্রস্তুতির আয়োজনও ভিন্ন। নগরবসীর জান-মাল সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছি। আমাদের নির্দেশনা মেনে সমন্বিতভাবে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করলে এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব। যেহেতু এখন করোনার প্রাদুর্ভাব রয়েছে, তাই তাড়াহুড়ো না করে অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব মেনে ও সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে কার্য সম্পাদন করতে হবে।
আম্ফান ঘিরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম জেলায় আশ্রয়কেন্দ্র আছে ৫২৭টি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আছে ৭২টি। এর মধ্যে নগরে আছে ৪০টি। তবে ৫২৭টি আশ্রয়কেন্দ্রের বাইরে নতুন করে খোলা হয়েছে ১ হাজার ২৪৩টি। সব মিলিয়ে ১ হাজার ৭৭০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর বাইরে ২ হাজার ২৬৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১ হাজার ২৫০টি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য। এছাড়া সম্ভাব্য দুর্যোগে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬ হাজার ৬৬০ সিপিপি স্বেচ্ছাসেবক, আট হাজার জন রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক এবং ৩৬০ জন স্কাউট সদস্য। গঠন করা হয় ২৮৪টি মেডিকেল টিম। তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ২ লক্ষ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের কাছে ১ লক্ষ ৪০ হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় ত্রাণসামগ্রীও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার, ২৮ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন চাল, নগদ দুই লাখ ২০ হাজার টাকা, ১৩৩ বান্ডিল ঢেউটিন ও ৫০০টি তাঁবু মজুদ রাখা হয়েছে। এছাড়া করোনাসহ ঘূূর্ণিঝড় মোকাবেলায় এক হাজার মেট্রিক টন চাল, ৫০ লাখ টাকা, ২০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৫০০ বান্ডিল ডেউটিন বরাদ্দ চেয়ে দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে (০৩১-৬১১৫৪৫ ও ০১৭০০৭১৬৬৯১) যোগাযোগ করা যাবে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল মজুদ রেখেছে ৫০ হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং এক হাজার ৪০০ পিস হাইজিন কিডস। কন্ট্রোল রুম খুলেছে সিএমপিও (০১৪০০৪০০৪০০ ও ০১৮৮০৮০৮০৮০)।
এদিকে গতকাল দিনভর নানা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ফায়ার সার্ভিস, রেডক্রিসেন্ট, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) আওতাধীন স্বেচ্ছাসেবকগণ ও সিএমপি। সংস্থাগুলোর পক্ষে কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে।
চসিকও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে নগরবাসীকে যে কোনো জরুরি সেবা দেয়ার জন্য দামপাড়ায় কন্ট্রোল রুম (০৩১-৬৩০৭৩৯ ও ০৩১-৬৩৩৬৪৯) খোলা হয়েছে। সম্ভাব্য দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের জন্য শুকনো খাবার, পর্যাপ্ত সুপেয় পানি এবং চিকিৎসা সেবাদানের জন্য মেডিকেল টিম ও পর্যাপ্ত ওষুধপত্র মজুদ করছে সংস্থাটি। সিটি মেয়র দিনভর সবকিছু মনিটরিং করেন।
এছাড়া দামপাড়া কন্ট্রোল রুম থেকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড ৫, ৭, ৯, ১০, ১১, ২৬, ৩৪, ৩৫, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪১-এর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলদের সাথে। ওইসব এলাকার বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে স্থানান্তর করা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নিজেদের ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে জীবণুনাশক স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রেখেছে। জরুরি চিকিৎসাসেবায় চসিকের মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রাম আনোয়ারা বাশঁখালীর বেড়িবান ঝুকির মধ্যে রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের চারটি ওয়ার্ডসহ চট্টগ্রাম জেলার আশপাশের এলাকায় সাগরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঢুবে জলবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভবানা রয়েছে।
প্রশাসন তথা সেচ্ছাসেবকদের পাশাপাশি আমাদের গণমাধ্যমকর্মীরা সাইক্লোন আম্ফানের বিপদের ঝুকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে যাচ্ছে।