রুবেল হোসেন
রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎপত্তি থেকে অদ্যবদি বিশ্বের নানা প্রান্তে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। কোনটি নিয়মতান্ত্রিক কোনটি অস্বাভাবিক। গণ আন্দোলনের মুখে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বের বহু শাসকের পতন হয়েছে। অনেকে আবার ঘুরেও দাড়িয়েছে। কেউ হয়েছেন নন্দিত আবার কেউ কেউ পরিনত হয়েছেন মহানায়ক থেকে খলনায়কে। আজকে আলোচ্য বিষয় একবিংশ শতাব্দির দুইটি উন্নয়নশীল দেশের রাষ্ট্রনায়কের মহানায়ক থেকে খলনায়কে পরিনত হওয়ার কাহিনী। একজন জিম্মাবুয়ের রবার্ট মুগাবে আরেকজন বাংলাদেশের শেখ হাসিনা। আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা ও বিশাল প্রতাপশালী থেকে জনধিকৃত হয়েছেন তারা। মহানায়ক থেকে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের খলনায়কে। বিশ্বের ইতিহাসে একটানা ৩৭ বছর ক্ষমতায় থাকা রবার্ট মুগাবের পতন হয় সেনা অভ্যুথানের মাধ্যমে আর বাংলাদেশের ছাত্র জনতার অভ্যুথানে ক্ষমতা ছেড়ে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
এক:
প্রথম আলোচনায় আসি রবার্ট মুগাবে প্রসঙ্গে। তিনি ছিলেন জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতার নায়ক। বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘদিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় থাকার কৃতিত্বও তার। একাধারে ৩৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও দেশের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের অবসানে তার অবদান কংবদন্তিতূল্য। পশ্চিমা নীতির, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের কড়া সমালোচক ছিলেন রবার্ট মুগাবে। যুক্তরাজ্যকে ‘শত্রু দেশ’ হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। ১৯২৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রোডেশিয়ায় জন্ম নেওয়া রবার্ট গ্যাব্রিয়েল মুগাবে ব্যক্তিজীবনে লাভ করেন ৭ টি একাডেমিক ডিগ্রি। ঘানায় স্বাধীনতা পরবর্তী নেতা কোয়ামে এনক্রুমাহ’র আফ্রিকান একত্ববাদের আদর্শ তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করা মুগাবে হয়ে ওঠেন জিম্বাবুয়ের অবিসংবাদিত নেতা, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়নের (জানু) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হওয়ার আগে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জশুয়া এনকোমোর সাথে কাজ করেন তিনি। ১৯৬৪ সালে এক ভাষণে রোডেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার সমর্থকদের ‘কাউবয়’ বা মেষপালক বলার পর মুগাবেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর প্রায় এক দশক কোন বিচার ছাড়াই তাকে আটকে রাখা হয়।
তিনি কারাগারে থাকাকালীন সময়ই তার শিশু সন্তান মারা যায়। তাকে ছেলের শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়ারও অনুমতি দেয়নি কারা কর্তৃপক্ষ। ১৯৭৩ সালে আটক থাকা অবস্থাতেই রাজনৈতিক দল-জানু’র সভাপতি হন তিনি। রোডেশিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে হওয়া রক্তক্ষয়ী আলোচনা চলাকালীন সময় আফ্রিকান নেতাদের মধ্যে মুগাবেই ছিলেন সবচেয়ে আগ্রাসী, এবং দাবি আদায়ে সেসময় তার ভূমিকাই ছিল সর্বাপেক্ষা আপোষহীন। ১৯৭৬ সালে লন্ডন সফরের সময় তিনি মন্তব্য করেন যে, রোডেশিয়া সমস্যার একমাত্র সমাধান আসতে পারে বন্দুকের নল থেকে। সেসময় সংবাদমাধ্যম তাকে ‘চিন্তাশীলের গেরিলা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।
১৯৭৯ সালে ল্যানসাস্টার হাউজ চুক্তি অনুযায়ী ‘জিম্বাবুয়ে প্রজাতন্ত্রী’র জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যে সংবিধান মোতাবেক রোডেশিয়ার নতুন নাম ঠিক করা হয় জিম্বাবুয়ে। জিম্বাবুয়ের প্রথম সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত হয় ১৯৮০ র ফেব্রুয়ারিতে। নির্বাচন করা মুগাবে বিপুল ব্যবধানে জয়লাভ করেন। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অনেকে ঐ বিজয়কে অপ্রত্যাশিত হিসেবেও আখ্যা দিয়েছিলেন। সেবারের নির্বাচনে ‘স্বঘোষিত মার্ক্সবাদী’ মুগাবে যখন জয়লাভ করেন তখন অনেক শ্বেতাঙ্গই আতঙ্কে রোডেশিয়া ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তবে মুগাবের মধ্যমপন্থী এবং শান্তিপূর্ণ বক্তব্য তার অনেক সমর্থককেই সেসময় আশ্বস্ত করেছিল। সেসময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বিরোধীদের ভুক্তভোগী করা হবে না এবং ব্যক্তিগত সম্পদকে রাষ্ট্রের দখলে নেয়া হবে না। তিনি দাবি করেছিলেন তার রাজনীতির মূল প্রতিপাদ্যই হবে বন্ধুবৎসলতার প্রসার। ফলে কিংবদন্তিতে পরিনত হতে থাকেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় সমর্থন প্রকাশ করায় মুগাবে আর এনকোমোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে।
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুগাবে ধীরে ধীরে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কন্ঠরোধ করেছিলেন। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে হাজার হাজার এনডেবেলেস গোষ্ঠীর মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, যারা এনকোমোর আদি বাসস্থান মাতাবেলেল্যান্ডের অধিবাসী ছিল এবং যাদেরকে এনকোমোর সমর্থক হিসেবে মনে করা হতো।
প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত ঘোষণা করার পর ১৯৮৭ সালে জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট হন মুগাবে। ১৯৯৬ সালে তৃতীয় দফায় নির্বাচিত হন তিনি। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে তার সরকারের বিরোধী দলের সমর্থনে থাকা শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের খামার দখল এবং তাদের অধীনে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ কৃষকদের হত্যা করে মুগাবের তথাকথিত ‘যুদ্ধফেরত’ বাহিনী।
জিম্বাবুয়ের কৃষিখাত প্রায় ধ্বংসের মুখে যাওয়ার কারনে মুগাবের সমালোচকরা তাকে দোষারোপ করেন। সমালোচকদের দাবি ছিল, জমির মালিকানা পুনর্বিন্যাস করার পর গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তা হস্তান্তর করার বদলে নিজের পছন্দের ব্যক্তিদের সেসবের দায়িত্ব দেন তিনি। আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি খাদ্য উৎপাদন করা দেশগুলোর একটি থেকে দ্রুত বিদেশি বিনিয়োগ নির্ভর দেশে পরিণত হয় জিম্বাবুয়ে।
২০০২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুগাবে প্রায় ৫৭% ভোট পান এবং তার বিরোধী দল এমডিসি পায় প্রায় ৪২% ভোট। ঐ নির্বাচনে মুগাবের বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখানো এবং অনেক গ্রামে ভোটারদের ভোট দেয়া থেকে রুখতে ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সহিংসতা এবং জালিয়াতির অভিযোগ থাকায় সেসময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা দেয়নি। তারপর থেকেই মুগাবে এবং জিম্বাবুয়ে বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে শুরু করে।
২০০৮’এর মার্চে প্রথম দফা নির্বাচনে হারলেও জুনে দ্বিতীয় দফায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী মি. স্ভাঙ্গিরাই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে আবারো নির্বাচিত হন তিনি। মি. সভাঙ্গিরাইয়ের সমর্থকদের ওপর হামলা নির্যাতন অব্যাহত থাকায় কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে দাবি করে আসছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে আবারো ৬১% ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুগাবে, যার ফলে আবারো এককভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তিনি। সেবারের নির্বাচনেও কারচুপির অভিযোগ ওঠে তবে সেসময় আগের নির্বাচনগুলোর মত সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। এরপর ধীরে ধীরে মুগাবের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ধারণা করা হতে থাকে যে তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন তার স্ত্রী গ্রেস মুগাবে। ২০১৫ সালে রবার্ট মুগাবে ঘোষণা করেন যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, যখন তার বয়স হওয়ার কথা ৯৪।
ফেব্রুয়ারি ২০১৬’তে তার উত্তরসূরি কে হবেন – এমন আলোচনা চলাকালীন সময় এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর তুলে নেয়ার আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবো।’ এই ক্ষমতার লোভ ও দম্ভ তাকে পরিনত করে কলনায়কে। ৯৪ বছর বয়সে যখন টালমাটাল অবস্থা তখন তিনি পরিকল্পনা আটেন স্ত্রী গ্রেস কে দেশটির প্রেসিডেন্টের আসনে বসানোর। তার এই পরিকল্পনা তার দল, কেবিনেট, সেনাবাহিনী তথা দেশটির জনগণ কেউ সমর্থন করেনি। নিজের একক স্বৈরাচারী ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝিতে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন নানগাগওয়াকে বরখাস্ত করেন মুগাবে। ফলে তখনই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার স্ত্রী গ্রেস এর পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হওয়ার আলোচনা। তীব্র হতে থাকে জনরোষ। এমনই অবস্থায় যে সেনাবাহিনীর উপর ভর করে আজীবন ক্ষমতা আকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন মুগাবে সেই সেনাবাহিনীর হাতেই তার পতন হয়। ১৪ নভেম্বর ঐতিহাসিক রক্তপাতহীন অভ্যুথান সংঘঠিত করে দেশটির সেনাবাহিনী। ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। অবসান হয় বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘদিন তথা ৩৭ বছরের শাসনের। ১৫ই নভেম্বর গৃহবন্দী হন মুগাবে এবং তার চারদিন পর তার রাজনৈতিক দল জানু-পিএফ পার্টির শীর্ষ নেতার পদ থেকে প্রতিস্থাপিত হন। পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার আগে তিনি এবং তার পরিবার ভবিষ্যতে যাতে বিচারের সম্মুখীন না হন – সেজন্য একটি চুক্তিও করেন। এর ফলে তার কিছু ব্যবসায়িক স্বার্থও রক্ষা হয়েছিল। তিনি কূটনৈতিক মর্যাদাসহ গাড়ি-বাড়িরও সুবিধা ভোগ করতে ছিলেন।
আফ্রিকা থেকে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা দূর করতে মুগাবে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন বলে মনে করা হতো, যার জন্য তিনি পুরো আফ্রিকায় নায়কের সম্মান পেতেন – সেই মুগাবেই পরিণত হয়েছিলেন স্বৈরশাসকে। ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন করে একসময়কার সমৃদ্ধশালী জিম্বাবুয়েকে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত করেছিলেন তিনি।
দুই:
এবার আলোচনায় আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। স্বাধীনতাত্তোর সময়ে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের পতন হয় ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট। সেই ঘটনার বিতর্কে আমি যেতে চাচ্ছি না। মহান স্বাধীনতার কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা অস্বাভাবিক পন্থায় পরিচালিত হয়। অভ্যুথান-পাল্টাাভ্রুথান, হত্যা, ক্যু ও অবৈধ সেনাশসনের যাতাকলে পিষ্ট হতে থাকে বাংলাদেশ। দেশের সেই ক্রান্তিকালে ধুমকেতুর মত আবির্ভাব হয় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন তিনি। হাল ধরেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের। ৯০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থীদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই করেছেন তিনি। সামরিক জান্তা এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলনের পর তার পতন হয়েছিল। সে আন্দোলনে প্রায় ৩৭০ জন জীবন দিয়েছিলেন, পঙ্গু-গুম হয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। হরতাল হয়েছিল প্রায় ১ বছর ৩২৮ দিন! অবরোধ হয়েছিল ৭০ দিন। জাতীয় সম্পদ ও আর্থিক ক্ষতিও হয়েছিল প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে দ্বিতীয় বারের মত গণতন্ত্রের ধারা ফিরে আসে। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে শেখ হাসিনার অবদানও কোন অংশে কম নয়। গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা ও মানুষের অধিকারের প্রশ্নে করাবরণও করেছেন তিনি। সবশেষ জননিন্দিত হয়ে ছাত্র জনতার অভ্যুথানে তার পতন হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘকাল প্রধানমন্ত্রীর আসনে থাকা শেখ হাসিনা একসময় স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যাবহার, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম, সব সেক্টরে দলীয়করণ, ভিন্নমত দমনে দমনপীড়ন বা জেলজুলুম তো আছেই তার যাথে তিনি হত্যা ও গুমের মত কাজ করতেও কুন্ঠিত হন নি। চলুন জনপ্রীয়তার শীর্ষ থেকে খলনায়কে পরিনত হওয়ার ঘটনার বিবরণ কিছুটা হলেও জানা যাক।
এ বছরের পাঁচই জুন যখন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দেয়, তখন কারো ধারণাই ছিলো না যে পরের দুই মাসের মধ্যে সেটিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটবে। শেষ পর্যন্ত এটি শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের টানা শাসন অবসানের দিকে নিয়ে গেছে।
আন্দোলনটি শুরুতে ছাত্রদের কোটা সংস্কার কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে এর সাথে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার, নানা বয়সের লাখো মানুষ অংশ নিতে শুরু করে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগ যে বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছিল, প্রায় ৫০ বছরের মাথায় দলটি আবার সেই একই অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু পুরো পরিস্থিতি কীভাবে এবং কেন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছালো, যাতে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটির বিরুদ্ধে এভাবে রাজপথে নেমে আসলো? কেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে থাকা শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হলো?
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে আর মেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে বের হতে চায়নি। একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরোধীদের ও বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, আমলা আর প্রশাসনের ওপর নির্ভর করে তার টিকে থাকার প্রবনতা এই পতনের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। যে সেনাবাহিনীর উপর ভর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত সেই সেনাবাহিনীই তাকে কোন প্রকার সাহায্য করে নি।
১৫ বছরের একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, জিনিসপত্রের দাম, গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা, লুটপাট, ব্যাংকিংয়ের অনিয়ম সব কিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ কোটা আন্দোলনের একটা উপলক্ষ্য করে একটা পরিবর্তনের আশায় রাজপথে নেমে আসে।’
২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে ২০১৪ ও ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অনেকটা একতরফা নির্বাচন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিলেও সেখানে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল। রাতের আধারে দেশের প্রায় সবকটি আসনে ব্যালট বক্স ভর্তি করে রাখা হয়। এমনকি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করেছে। সেসব নির্বাচনও বেশিরভাগ সময় একতরফা হয়েছে। যেখানে বিএনপি বা অন্য রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছে, সেখানেই অনিয়ম বা কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ফলে গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার বা মতামত জানানোর কোন অধিকার পায়নি।
বিরোধী রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ শত শত নেতাকর্মীকে গুম, মামলা বা সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল। অনেক নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। কারো কারো এখনো কোন হদিসই মেলেনি। এভাবে নানা অনিয়ম, অত্যাচার জুলুমের বেড়াজাল ভেঙে মানুষ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারকে উৎখাত করে। জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনকে বিরোধী দলের মত স্টাইলে দমনের চেষ্টা করতে গিয়ে আন্দোলনে ঘি ঢেলেছিলেন শেখ হাসিনা ও তার দোসররা। ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়ে, মামলা দিয়ে জেলে ভরে পরিস্থিতি এমন বিষিয়ে তুলেছিলেন যে পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বলতে পারেন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাই পতনের মূল কারণ। গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। পতন হয় টানা ১৬ বছরের শাসনের। দেশ ছেড়ে নিজের ব্যক্তি ইমেজ, দল, পরিবারের যেমন অসীম ক্ষতি করেছেন তেমনি দেশের স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এমনকি মহান মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তী শেখ মুজিবকে দাড় করিয়ে গেছেন এক মহা বিতর্কের জায়গায়। গ্রাম্য একটা প্রবাদ শুনতাম যে পাচু মরে আরো দশ ঘর নিয়ে মরে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছে বললে ভুল হবে না আশা করি।
সর্বশেষ, বিভিন্ন দেশের ইতিহাসেও দেখা গেছে, জোর করে ক্ষমতায় থাকা দল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এক সময় আমলা, প্রশাসন বা পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পৃথিবীর বুকে সকল স্বৈরশাসকেরই পতন হওয়ার নজির আছে। আর সেই পতন হয় ভয়াবহ, নিন্দিত, ঘৃণিত। রবার্ট মুগাবে ও শেখ হাসিনার উত্থান ও পতনের ধারাবাহিক পর্যালোচনা করলে আর কোন উপমা দেখার প্রয়োজন হয় না। ইতিহাসের এই দায় থেকে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনায়কদের শিক্ষা নিতে হবে। তামের মনে রাখতে হবে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতা একসময় যাবেই। ক্ষমতা যাওয়ার পর হয় ভালোবাসা পাবেন না হয় ঘৃণা। কোনটি নিবেন সেই বাচ-বিচারের দায়িত্ব আপনার। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো ফ্যাসবাদ ফিরে না আসুক সেটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।