সচ্চিদানন্দ দে সদয়
আজ মঙ্গলবার শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথ যাত্রা।সনাতন ধর্মাল্বামীরা এ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকেন। রথযাত্রার ইতিহাস টা হয়তো অনেকের অজানা, স্কন্দ পুরানে আমরা পাই যে ইন্দ্রদ্যম্ন নামে এক রাজা ছিলেন উত্কল রাজ্যে (বর্তমানে যা উড়িষ্যা)। তিনি ছিলেন একজন পরম ভক্ত। একদিন স্বপ্নাদিষ্ট হন একটি মন্দির নির্মানের জন্যে। পরে দেবর্ষী নারদ এসে জানন স্বয়ং ব্রহ্মার ও তাই ইচ্ছা, তিনি নিজে সেটা উদ্বোধন করবেন। এভাবে কাজ হল এবং নারদ বললেন বহ্মাকে আপনি নিমন্ত্রন করুন। পরে রাজা ব্রহ্মলোকে গেলেন এবং নিমন্ত্রন করলেন। কিন্তু ব্রহ্ম লোকের সময় এর সাথে তো পৃথিবীর মিল নাই। পৃথীবিতে কয়েক শত বছর পার হয়ে গেছে। ফিরে এসে রাজা দেখলেন তাকে কেউ চেনে না। যা হোক তিনি আবার সব করলেন। দৈবভাবে রাজা জানতে পারলেন সমুদ্র সৈকতে একটি নিম কাঠ ভেসে আসবে, সেটা দিয়েই তৈরি হবে দেব বিগ্রহ। এদিকে মূর্তি তৈরি শুরুর কিছু দিন পর রানী কৌতুহল সংবরন করতে না পেরে মন্দিরে যান এবং দেখেন কেউ নেই ভিতরে আর আমরা যে রূপে এখন জগন্নাথ দেব কে দেখি সেই মূর্তিটি পড়ে রয়েছে। পরে ঐ ভাবেই স্থাপিত হয় মূর্তি। ইন্দ্রদুম্ন রাজা জগন্নাথ দেবের মূর্তিতেই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তিতে শ্রীকৃষ্ণ এবং জগনাথ দেব একই সত্ত্বা চিন্তা করে একই আদলে তার পাশে ভাই বলরাম এবং আদরের বোন সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করা হয়। আমাদের এখানে এক রথ যাত্রা হলেও পুরিতে তিনটি রথে হয়। প্রথমে বলরাম তার পর সুভদ্রা এবং শেষে জগন্নাথ। ১১৯৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজা অনঙ্গভীমদেব তিন রথের রথ যাত্রা প্রচলন করেন। কঠোপনিষদে বলা হয়েছে “না আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেবতু”। এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। রথ যাত্রার রুপক এমনই। তিনি আমাদের অন্তরে থাকেন। তার কোন রুপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত অর্থাৎ ঈশাব্যাসমিদং। বেদ বলছে আবাঙমানষগোচর, মানে মানুষের বাক্য এবং মনের অতিত। আমরা মানুষ তাই তাকে মানব ভাবে সাজাই।শ্রীমদ্ভাগবতে আছে ,যে ব্যক্তি রথে চড়ে জগন্নাথদেবকে বিশ্বব্রহ্মান্ড দর্শন করাবেন অথবা শ্রী ভগবানের রূপ দর্শন করাবেন ভগবান তাদের প্রতি অশেষ কৃপা বর্ষণ করেন। বৃহন্নারদীয় পুরাণে আছে,ভগবান নারায়ন লক্ষ্মী দেবীকে বলেছেন, ”পুরুষোত্তম ক্ষেত্র নামক ধামে আমার কেশব-মূর্তি বিরাজমান। মানুষ যদি কেবল সেই শ্রীবিগৃহ দর্শন করে তবে অনায়াসে আমার ধামে আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।” এছাড়া বিষ্ণুপুরাণেও এর মহিমা ও পুণ্যফলের কথা বিধৃত হয়েছে। বৃন্দাবনে গোপীরা একদিন কৃষ্ণের লীলা ও তাঁদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা আলোচনা করছিলেন। কৃষ্ণ গোপনে সেই সকল কথা আড়ি পেতে শুনছিলেন। তখন গোপীরা কৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে দিয়েছিলেন যখন গোপীরা কৃষ্ণ নিয়ে আলোচনা করবেন তখন কৃষ্ণ যাতে তাঁদের কাছে আসতে না পারে। সেদিকে নজর রাখবে সুভদ্রা। এদিকে গোপীদের কৃষ্ণপ্রীতির কথা শুনতে শুনতে দেখে এতই বিমোহিত হয়ে পড়েন যে ভুলে যান তাঁর নিজ কর্তব্য। ফলে তাঁর দুই দাদা কৃষ্ণ ও বলরাম এগিয়ে এলেও তিনি খেয়াল করেননি। এদিকে গোপীদের কথা শুনতে শুনতে দুই ভাইয়ৈ কেশ খাড়া হয়ে উঠল, হাত গুটিয়ে আসে, চোখ দুটি বড় বড় হেেযে যায় এবং মুখে আনন্দের উচ্চ হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এই কারণেই জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এমন রূপ ।বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের এই বিমূর্ত রূপটিকে পূজা করে থাকেন। প্রশ্ন জাগে, যে মূর্তি নিয়ে এই রথযাত্রা সেই রথারোহী দেবতা কে? বিশাল অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রথারোহী দেবতার ক্ষেত্রে কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। পুরনো কোনো কোনো লেখায় পাওয়া যায়- বৌদ্ধ সামাজিক উৎসবে রথে করে বুদ্ধমূর্তি নিয়ে পথ পরিক্রমা করা হতো। কথিত আছে, পুরীতে একবার রথযাত্রা উপলক্ষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ রথে আরোহণ করিয়ে রথ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। উচ্চ-ধমীয় হিন্দু নরনারী, রাজ-কর্মচারীবৃন্দ রথের রশি ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগে টানছেন কিন্তু রথের চাকা অনড়। খবর পেয়ে দেশের রাজা প্রতাপ রুদ্র্র সপরিষদ এসে রথের রশি ধরে আকর্ষণ করতে লাগলেন; তথাপি রথের চাকা স্থির, নিশ্চল। তখন জগন্নাথ বললেন- যে নিম্ন বর্ণের মানুষদের তোমরা অচ্ছুত-অন্ত্যাজ বলে দূরে সরিয়ে রেখেছ, তাদের রথের রশি ধরার সুযোগ দাও, তোমাদের শক্তির সঙ্গে ওদের শক্তিও যোগ কর তাহলেই রথ তার গতি ফিরে পাবে। অনেক টালবাহানার পর সমাজে পিছিয়ে থাকা অচ্ছুত অন্ত্যজদের রথের রশি ধরার অনুমতি মিলল এবং রথ চলা শুরু করলো।
এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে সমাজের উচ্চমার্গের শক্তির সঙ্গে যে মুহুর্তে যোগ হলো তথাকথিত অন্ত্যজদের শক্তি- সবাইকে অবাক করে দেবতার রথের চাকা তখনই সশব্দে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। সামগ্রিক বিচারে রথযাত্রা হলো সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার প্রতীক। সামাজিক ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও দায়-দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজের কোনো অংশকে কুলষিত করলে, অচ্ছুত-অন্ত্যজ বলে দূরে সরিয়ে রাখলে সমাজের সামনের দিকে এগিয়ে চলার গতিও রুদ্ধ হয়ে পড়ে; সমাজ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সমাজ তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে সমাজের উচ্চ-নীচ, ধনী-নির্ধন, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ যদি নিশ্চিত হয়, তবেই সমাজ সামনে এগিয়ে চলে। এক কথায়, রথযাত্রা মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীভাব জাগায়, সমাজের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে মানুষকে সমষ্টিগতভাবে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে। এই হলো রথযাত্রার অন্ত নিহত তাৎপর্য। পুরী ছাড়াও বিশ্বের অনেক হিন্দু এলাকাতেই রথ উৎসব পালন করা হয়। যেমন, নিউ ইয়র্ক, টরেন্টো, লাওস সহ বাংলাদেশেও রথ উদযাপন হতে দেখা যায়। যেমন বাংলাদেশের সাভারের ধামরাইয়ে। এখানে প্রতি বছর ধুমধাম করে পালন করা হয় যশোমাধবের রথযাত্রা। এছাড়া, টাংগাইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, খুলনা ইত্যাদি জেলাতেও বড় করে পালিত হয় রথযাত্রা। এতে অংশ নেয় ধারের কাছের গ্রাম, উপজেলার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এবং উপভোগ করতে আসে সকল ধর্মের মানুষই। রথকে কেন্দ্র করে চমৎকার মেলা বসে বিভিন্ন স্থানে। রথের সাথে কলা বেচা ও লটকনের বিশেষ সম্পর্ক আছে। তাই প্রচুর কলা ও লটকন কেনাবেচা হয় রথে। শুকনা খাবার, যেমন- খই, মুড়ি-মুড়কি, চিরা ভাজা, জিলাপী, আমিত্তি ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য নিয়ে বসেন বিক্রেতারা। শুধু এগুলোই নয়, হাতে তৈরি মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, কাপরের পুতুল, বাচ্চাদের খেলনা, তৈজসপত্র, কাঠের ঠাকুরঘর আরও নানা রকম সামগ্রীও পাওয়া যায় রথের মেলাতে।
(সূত্র: বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ)
লেখক: সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী