
জাতীয় ডেস্ক:
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার প্রধান ডিআইজি হারুন অর রশীদ বলেছেন, রাজধানীর গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজার এলাকায় বিস্ফোরিত কুইন সেনেটারি মার্কেট ভবনটি নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এটা রাজউকের দেখা উচিত ছিল। অনুমতি নিয়ে বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না তা তদন্ত করা হবে।
তিনি বলেন, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ তিতাসের যেসব ব্যক্তিদের দেখার কথা ছিল তারা এগুলো দেখেছেন কি না সেটিও তদন্ত চলবে।
বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
এসময় ডিএমপি গোয়েন্দা শাখার প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, সিদ্দিক বাজারের যে ভবনটিতে বিস্ফোরণ ঘটে তার নাম কুইন সেনেটারি মার্কেট। এক সময় এটার নাম ছিল কুইন ক্যাফে। ১০ তলা ভবনের প্ল্যান করা হলেও ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বেইজমেন্ট ও এক তলা কমপ্লিট ছিল।
এর বেইজমেন্টে ছিল রান্নাঘর আর এক তলায় ছিল খাবার হোটেল। এ রান্নাঘরে কমার্শিয়াল গ্যাসের বড় লাইন ছিল যা পরে লিখিতভাবে তিতাসের কাছে সারেন্ডার করা হয়।
২০০৪ সালে ভবনটির সাত তলা পর্যন্ত কমপ্লিট করা হয়। বর্তমানে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বেইসমেন্টসহ সাত তলা পর্যন্ত ভবনটি কমপ্লিট আছে। ভবনটির প্রকৃত মালিক মরহুম হাজী মোহাম্মদ রেজাউর রহমান। ২০১১ সালে তার মৃত্যুতে তার তিন ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বর্তমানে ভবনটির মালিক।
পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে হারুন অর রশীদ বলেন,
১. বেইজমেন্টে কার পার্কিং থাকলে বাতাসের ভেন্টিলেশন থাকতো। কোনো গ্যাস জমা হতো না। বিস্ফোরণও হয়তো হতো না।
২. সাত তলা ভবনের বেইজমেন্টসহ তিনটি ফ্লোরের কমার্শিয়াল লোকজন, বাসা বাড়ির লোকজনের পয়োবর্জ্য যেখানে জমা হয় দীর্ঘ সময় সেই জায়গা পরিষ্কার না করায় সেখানেও বায়ো গ্যাসের জন্ম হতে পারে, যা বিভিন্ন কারণে বিস্ফোরিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করে।
৩. এক সময় এ বেইজমেন্টের রান্নাঘরে কমার্শিয়াল বড় লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হতো যা পরবর্তীতে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য ফ্লোরের ডোমেস্টিক লাইন এখনো চলমান। ফলে এ লাইন সম্পূর্ণ বন্ধ না হয়ে সেখান দিয়েও তিতাস গ্যাস লিক হতে পারে। কোনোভাবে জমা গ্যাসে স্পার্কের মাধ্যমে বিস্ফোরণের হতে পারে।
৪. ভবন মালিকদের তথ্য মতে, মূল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং তার উত্তর পাশে ব্র্যাক ব্যাংকের ভবনের মধ্যখানে সরু একটি গলি আছে। এ গলিতে পয়োবর্জ্য পদার্থের সেপটিক ট্যাংকি, এসির আউটার ইত্যাদি অবস্থিত। বিস্ফোরণে সেপটিক ট্যাংকের পাশের দেয়ালগুলো সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পয়োবর্জ্য পদার্থের বায়ো গ্যাসের বিস্ফোরণে এমনটি হতে পারে।
৫. ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ড বা বেইজম্যান্টে বড় একটি সেনেটারি দোকান, নিচ তলায় ৫টি দোকান, দোতলাতে কাপড়ের ২টি দোকান ছিল, যেগুলোর জন্য অনেক কাঁচ এবং ইন্টেরিয়রের কাজ করা হয় এবং পাওয়ারফুল এসি ব্যবহার করা হয়। এসিগুলো সময়ে সময়ে সার্ভিসিং না করালে বা ত্রুটিপূর্ণ থাকলে তা থেকেও বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে যেটা ২/৩ বছর আগে গুলশানে আরব আমিরাতের ভিসা সেন্টারে ঘটেছিল।
৬. ভবনটি কোনো পরিত্যক্ত পাবলিক স্পেস/ ভবন নয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন। বিভিন্ন ব্যবসায়ির সার্বক্ষণিক নজরদারি ও সিসি ক্যামেরার সার্ভিলেন্সে ছিল এটি। ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে পরিমাণ বিস্ফোরক প্রয়োজন তা এখানে সবার অজান্তে জমা রাখা প্রায় অসম্ভব।
৭. বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ঢাকা মহানগরীর সিটিটিসির বোম্ব ডিসপোজাল টিম আলাদা আলাদা ভাবে তদন্ত করছে। বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা একটা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে রিপোর্ট দেবেন তাতেই প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে এখনো পর্যন্ত বিস্ফোরক বা সেবুট্যাজের কোন আলামত সেখানে পাওয়া যায়নি।
৮. ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরা ছিল। সিসি ক্যামেরার ডিভিআর থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। ভবনের মালিক, দোকানের মালিকদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিস্ফোরণের কারণ জানা চেষ্টা অব্যাহত আছে।
ভবন মালিক ও যারা ভাড়া নিয়ে সেখানে ব্যবসা ও বসবাস করে আসছিল তারা ঘটনার দায় এড়াতে পারে না দাবি করে হারুন অর রশীদ আরও বলেন, সেপটিক ট্যাংকি অপরিস্কার রাখা, এসি মেরামত না করা, গ্যাসের লাইন বন্ধ না রাখার দায় এড়ানো যায় না। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ছিল না, পার্কিং স্থানও ভাড়া দেওয়া ছিল। সব মিলিয়ে বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এজন্য তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছি।
তিনি বলেন, এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে কু্উইন্স সেনেটারি মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ড বিস্ফোরণের উৎস স্থল। বেইজমেন্টের এ আন্ডারে গ্রাউন্ড স্পেসটি রাজউকের বিধান অনুসারে খোলামেলা থাকলে সেখানে কোন ত্রুটি দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে নিরসন করা যেতো। বায়ু গ্যাসসহ অন্যান্য সমস্যারও সমাধান করা যেতো। বাড়ির মালিকরা টাকার লোভে আন্ডারগ্রাউন্ড এক সময় রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেই রান্নাঘরের গ্যাসের লাইন যথাযথভাবে অপসারণ না করে তার ওপরেই সম্পূর্ণ এয়ার টাইট এসি করা নির্মাণ সামগ্রীর মার্কেট বানিয়ে দিয়েছেন।
গোয়েন্দা প্রধান বলেন, দোকানের মালিক বিল্ডিং কোড না মেনে ভাড়া নিয়ে বেইজম্যান্টের ১ ইঞ্চি জায়গাকেও ফাঁকা না রেখে ডেকোরেশন করে দোকান বানিয়ে সেখানেই তার কর্মচারী ও ক্রেতা সাধারণের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। এতগুলো প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি তাই ভবনের মালিক এবং দোকানদারের স্বেচ্ছাচারিতা, লোভ এবং অবহেলারই ফল।
তবে রাজউকের উচিত ছিল ভবন নির্মাণে অনুমতি নেওয়ার পর বিল্ডিং কোড মেনে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল কি না। যারা ভবনটি থেকে ট্যাক্স আদায় করেন তাদেরও উচিত ছিল, যাদের ট্রেড লাইসেন্স দিচ্ছি, ট্যাক্স নিচ্ছি, তারা বিল্ডিং কোড ফলো করছে কি না! ডিবি পুলিশ ছাড়াও অন্যান্য সংস্থা ঘটনার তদন্ত করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, ভবন মালিক, দোকান মালিক, বাসিন্দাদের তো দায় ছিলই, রাজউক ও সিটি করপোরেশনেরও উচিত কার কি দায় ছিল তা তদন্ত করা।