সারা বিশ্বে সমস্ত জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। সুতরাং নারীদের ভূমিকা দেশ গঠনের ক্ষেত্রে, আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং যুব সমাজ অবক্ষয় রোধে ও শিশুদের লালন পালন এবং শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব ও ভূমিকা অপরিহায্য। ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকার দেশগুলিতে সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে নারীরা ঘরের এবং বাইরের বিভিন্ন কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কারনে তাদের দেশ বিশ্বে এত উন্নত। বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই শিক্ষার হার ছিল ১৮% তখন দক্ষিণ কোরিয়াতে শিক্ষার হার ছিল আমাদের চাইতে হিসাবে কম। কিন্তু এখন কোরিয়া কোথায় এবং আমরা কোথায়? এর পিছনে একটাই কারন কোরিয়ার মহিলারা পুরুষের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে বিভিন্ন কার্যকর্মে এবং শিল্প কলকারখানায় অংশগ্রহণ করেছে এবং পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও সময় ব্যয় করেছে, তাই তারা উন্নত। যে জাতির নারীরা যত শিক্ষিত হবে সে জাতি ততটা সভ্যতার আলো পাবে এবং উন্নত হবে। ৩য় বিশ্বের আমাদের মত দরিদ্র দেশ গুলোতে নারীদেরকে অন্ধকারে রাখার কারনে আমরা অনেকটা পিছিয়ে পড়েছি। পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে নাই। শিক্ষা অর্জন করতে চাইলেও তাদের কে বাধা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে এক ধরনের বন্দী জীবন যাপন করতে হয়েছে। তারা কখনো হয়েছে শাসিত, কখনো শোষিত বা নির্যাতিত, কখনও বা অধিকার থেকে বঞ্চিত, স্বামীর সেবা দেওয়া, সন্তান সন্ততি লালন পালন করা এবং রান্না ঘরের কাজই তাদের একমাত্র কাজ। এটাই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তাই সম্ভাবনাময়ী দেশের উন্নয়নের পরিবর্তে আমাদেরকে অনেকটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। নব্বই দশকের পর থেকে এই সত্যটা আমরা বুঝতে পেরে নারীদেরকে শিক্ষায় গুরুত্ব দেওয়ার কারনে আজকের নারীরা নিজেদের পায়ে দাড়াতে পারছে। তারা কেহ কেহ আজকের ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, পাইলট, সচিব, ডিসি, ইউ এন ও, ওসি, এস পি এবং স্কুল কলেজের শিক্ষিকাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ন কাজে এবং প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করছে। তাদের আজকের অধিকার প্রতিষ্টার এবং ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা দেওয়ার কারনে দেশ গড়ার কাজে এবং সার্বিক উন্নয়নে সুন্দর ভাবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। এবং বর্তমান সরকারের আমলে দেশ তরতর করে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমার দৃষ্টিতে নারীরা সমাজ ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ, সমাজে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধুমাত্র আমাদের দেশে নয় সারা বিশ্বে যুগের পর যুগ ধরে তাদের প্রকৃত প্রতিভা ও বিকাশকে বাধা গ্রস্ত করা হয়েছে। পুরুষের ভোগবিলাসীর আচরনের শিকার হতে হয়েছে তাদেরকে। সুতরাং নারীদের কে দেশ গড়ার কাজে ব্রত হতে হলে, তাদেরকে সাহসী করে গড়ে তুলতে হলে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শিক্ষার বিকল্প আর কিছুই নেই। তাই প্রত্যেকটা নারী সন্তানের উচিত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া শিক্ষার ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র শিক্ষাই পারে তাদের জীবনের সমস্ত বাধা অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ও নারী শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। সুতরাং নারীদেরকে ডাবিয়ে না রেখে তাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারলে শুধু পরিবারের জন্য নয়, প্রতিবেশীর জন্য, সমাজের জন্য এবং গোটা দেশের জন্য একধাপ উন্নতি করতে পারবে। তাই আমাদের সমাজের সবারই উচিত বিশেষ করে আমাদের পরিবারের সার্বিক উন্নতির জন্য নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া। আমাদের মনে রাখা উচিত যে, নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রসারন ঘটানোর জন্য সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের ইংরেজ শাসকরাই ভূমিকা পালন করে গেছেন। পরবর্তীতে বিশ্বকবি রবীন্দনাথ ঠাকুর, কথা সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিদ্যার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র, রাজা রামমোহন রায় এবং পরিশেষে মুসলিম নারী সমাজের জাগরনের অগ্রদূত, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এছাড়া বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ফজিলাতুন্নেসা, বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম সামছুন্নাহার ও নারী জাগরনে এবং নারীর উন্নয়নে ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনেক কাজ করেছেন। সুতরাং বর্তমান সময়ে এবং বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অবিসংবাদিত নেত্রী প্রধান মন্ত্রী, মানবতার জননী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নারীর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ও জীবনাদর্শের ব্যপক পরিবর্তন ঘটেছে। নারীর জীবন ধারার ও অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই তারা বর্তমান সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। একাবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নারী শিক্ষা এখন যৌবনে পদার্পন করেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একজন সুশিক্ষিত মা বা নারী-ই দিতে পারে সুন্দর সমাজ। নারী শিক্ষাকে আরও বেগবান করার জন্য সম্রাট নেপোলিয়ান বলেছেন, “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।” নারী শিক্ষা দ্বারা নারী জাতিকে উন্নত করাতে না পারলে দেশের উন্নয় করা আদৌ সম্ভব নয়। তাই সরকারসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার আরও বেশী বেশী উদ্যোগ নিতে হবে। পিছে পড়া নারীদের কিভাবে শিক্ষা জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় এবং আরও বেশী বেশী কর্মমূখী করা যায় সেই শিক্ষা তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে চালু করতে হবে। তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য ও সহযোগিতায় হাত বাড়াতে হবে। পারলেই আমাদের দেশ সমৃদ্ধশালী হবে এবং আমরা অবিলম্বেই বিশ্বের মানচিত্রে একটি অনন্য ব্যতিক্রম ধর্মী উন্নত দেশে প্রবেশ করতে পারবো একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সবাই মিলে নারীকে সম্মান দেই মর্যাদা দেই। তাদেরকে কখনও অবহেলা করবো না। শোষন করবোনা, নির্যাতন করবো না। তাদেরকে মায়ের আসনে বসাই। এখন থেকে কোন মেয়ে নির্যাতিত না হোক, তার ইজ্জত লুন্ঠন না হোক, ধর্ষিত না হোক এটাই আমরা আশা করি, সবাই মিলে আমরা তাদের নিরাপত্তা বিধান করি এবং সামগ্রিক সহযোগিতা করি তারা যেন নির্বিগ্নে তাদের কর্মকান্ডকে এগিয়ে নিয়ে দেশ গড়ার বিভিন্ন পর্যায়ের কাজে অংশ গ্রহন করতে পারে। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও তাই বলেছেন “বিশ্বে যা কিছু আছে মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”
লেখকঃ
জহিরুল ইসলাম শাহিন
সহকারী অধ্যাপক
বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ
কলারোয়া, সাতক্ষীরা।