
হাবিবুর রহমান/শেখ আব্দুল হাকিম:
শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর। আর যদি সেই শিক্ষক হয় দূর্নীতির প্রশ্রয়দাতা তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রসাতালে যাবেনা একথা অস্বীকার করার নয়। শিক্ষকদের ঐক্য বদ্ধ মিল বন্ধন ও সঠিক আলোর পথ প্রর্দশক হলো প্রথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ।
এক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতির নেতারা শিক্ষকদের সঠিক ভাবে নেতৃত্ব দানের পাশা-পাশি উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে ধাবিত করবে এবং দূর্নীতিকে প্রশ্রয় দিবেনা এটাই হবে তাদের মূল মন্ত্র। কিন্তু এখানে হয়েছে তার উল্টোটা। অভিযোগ উঠেছে,শ্যামনগর উপজেলার (প্রাথমিক) শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের পাঁচ মাস্টার মাইন্ড নেতার উষ্কানিতে শিক্ষা অফিসাররা শিক্ষা অধিদপ্তরের ১২টি প্রকল্প থেকে কোটি টাকা ঘুষ বানিজ্য করেছে।
শিক্ষা অফিসারদের এমন তুলকালাম দূর্নীতি কর্মকান্ডে উপজেলার সর্বত্র এখন শিক্ষক গোচের নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়,শ্যামনগর উপজেলায় ১৯১ টি বিদ্যালয় আছে। শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসব বিদ্যালয়ে উন্নয়ন খাতে ১১ টি প্রকল্পে বরাদ্দ আসে ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ¯িøপ খাতে ১৫১ টি বিদ্যালয়ে বরাদ্দ ছিলো ৯৫ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। যাহার মোট বরাদ্দ ৪ কোটি ৯১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। শ্যামনগর উপজেলা শিক্ষা অফিসার আক্তারুজ্জামান মিলনের আহবানে শিক্ষা অফিসে চলতি বছরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এক আলোচনা সভা হয়।
ঐ সভায় সহকারী চার শিক্ষা অফিসার মোঃ শাহ্ আলম, আজহারুল ইসলাম, সোহাগ হোসেন, সোহাগ আলম এবং শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পাঁচ নেতা সহ ১২ টি ইউনিয়ন শিক্ষক সচিব উপস্থিত ছিলেন। আরো উপস্থিত ছিলেন, শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল্যাহ আল মামুন সহ অন্যান্য নেতা গোচের শিক্ষকরা।
এ সময় শিক্ষা অফিসার উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিস ও উপজেলার প্রকৌশলী (এল জি ই ডি) অফিসের খরচের বিষয় আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায় সভায় উপস্থিত শিক্ষক নেতাদের সর্ব সম্মতি ক্রমে বরাদ্দ কৃত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের কাছ থেকে ¯িøপ খাতে ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য খাত অনুযায়ী ১০% থেকে ১৫% এমনকি ২৬% হারে নগদ টাকা তোলার বিষয়টি আলোচনা সভায় গৃহীত হয়।
সে-অনুযায়ী শিক্ষা কর্মকর্তারা কৌশলে শিক্ষা অধিদপ্তরের বরাদ্দ কৃত টাকা থেকে ঘুষ আদায়ের জন্য ১২ টি ইউনিয়ন থেকে পছন্দকৃত ১২ জন প্রধান শিক্ষক (সচিব) নির্বাচন করেন। অভিযোগ আছে, শিক্ষা অফিসাররা কথিত ১২ জন শিক্ষকদের বদলির ভয় দেখিয়ে সচিব পদ সৃষ্টি করে তাদেও মাধ্যমে স্ব-স্ব বরাদ্দকৃত বিদ্যালয় থেকে কোটি টাকা ঘুষ আদায় করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের কথিত পাঁচ মাস্টার মাইন্ড নেতারা হলেন, ৬২ নং আটুলিয়া আদর্শ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি দীনেশ চন্দ্র মন্ডল, ১২০ নং দক্ষিন ছোট কুপট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম (হেলাল), ১৬০ নং শিশু শিক্ষা নিকেতন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের সভাপতি পরিমল কর্মকার, ১২২ নং গাবুরা খোলপেটুয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন ও ১৫৭ নং ফুলবাড়ি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সহ সভাপতি গনেশ চন্দ্র সাহা।
উল্লেখিত পদে থাকা প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন সৃষ্টি কৃত সচিব পদ মর্যাদা নিয়ে শিক্ষা অফিসারদের হয়ে প্রধান শিক্ষকদের নিকট থেকে ঘুষ আদায় করেছেন। এদিকে রীতিমতন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম হেলালের মাধ্যমে শিক্ষা অফিসারদেরকে দেওয়ার জন্য ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছে বলে দাবী করেছেন ১৬৩ নং পুর্ব রমজাননগর স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সবুর। সে কারনে বলা চলে শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পাঁচ নেতারা ওতপ্রোত ভাবে শিক্ষা অফিসারদের কোটি টাকা ঘুষ বানিজ্যের সাথে জড়িত ছিল।
শিক্ষা অফিসারদের দূর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদ নেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাহিলে, ৯১ নং খ্যাগড়াদানা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল্যাহ আল মামুন, ৩০ নং ধুমঘাট এস এম সি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র মন্ডল, ১৩ নং হায়বাতপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান (লাভলু), ১২৭ নং পশ্চিম শ্রীফলকাটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হোসেন আলী, ১৩৪ নং মাহমুদপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাহতাব উদ্দীন সহ অন্যান্য প্রধান শিক্ষকরা বলেন, শিক্ষা অফিসারদের কোটি টাকা ঘুষ বানিজ্যের বিষয়টি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা পরিষদের নেতাদের অবহিত করলে অজ্ঞাত কারণে তারা নীরব ছিলেন।
শিক্ষা অধিদপ্তর হতে আসা বরাদ্দের টাকা শিক্ষা অফিস থেকে ছাড় করার পূর্বে শিক্ষা অফিসারের ডাকে শিক্ষা অফিসে আলোচনা সভা হয়। সভায় ১২ জন সচিবের উপস্থিতিতে শিক্ষক সমিতির নেতা দীনেশ চন্দ্র মন্ডল, সিরাজুল ইসলাম হেলাল ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ নেতা পরিমল কর্মকার, দেলওয়ার হোসেন, গনেশ চন্দ্র সাহা বরাদ্দের বিপরীতে ¯িøপ খাতে ২ হাজার টাকা ও অন্যান্য খাত অনুযায়ী ১০% থেকে ১৫% এমনকি ২৬% হারে টাকা তোলার বিষয়ে সম্মতি প্রদান করেন। তারা আরো বলেন, অঘোষিত ভাবে নেতা হওয়া ও দূর্নীতি করার জন্য পরিমল কর্মকার মনগড়া সুপরিকল্পিত ভাবে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষক পরিষদ নামীয় একটি সংগঠন শিক্ষক সমিতির বিপরীতে খাড়া করেছেন। শিক্ষক নেতাদের সহযোগিতা ও উস্কানিতে শিক্ষা অফিসাররা কোটি টাকা ঘুষ বানিজ্য করার সুযোগ পেয়েছেন।
এ ঘটনায় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, শিক্ষা অফিসার হিসাব রক্ষণ অফিস ও প্রকৌশলী (এল জি ই ডি )অফিসের খরচের টাকা যোগান দেওয়ার বিষয় আলোচনা করেন। শিক্ষা অফিসারের বরাত দিয়ে বলেন, শ্যামনগরে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বরাদ্দ সীমিত হওয়ায় টাকা তোলা আবশ্যক। সে কারণে টাকা তোলার বিষয়ে আমরা সম্মতি প্রদান করি।
এদিকে অঘোষিত বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক পরিষদের সভাপতি পরিমল কর্মকার ও সাধারণ সম্পাদক দেলওয়ার হোসেন বলেন, জুনের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষা অফিসারদের আলোচনা সভায় আমরা উপস্থিত ছিলাম না। নিজেদের সাফাই হিসাবে সভাপতি জানান, করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় ঐ দিন সভায় উপস্থিত হতে পারিনি। তবে তাদের দু-জনের বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন সভায় আলোচনায় থাকা ১২ জন সচিব ও শিক্ষক সমিতির নেতারা। তারা দাবী করেন শিক্ষা অফিসারের আলোচনা সভায় পরিমল কর্মকার, দেলওয়ার হোসেন ও গনেশ চন্দ্র সাহা টাকা তোলার বিষয়ে সম্মতি দেন।
এবিয়য়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবÍারুজ্জামার মিলন বলেন, চলতি বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে আমার অফিসে শিক্ষক সমিতির নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসে ছিলাম ঠিকই, তবে স্কুলের বরাদ্দ থেকে টাকা তোলায় আমি রাজি ছিলাম না। আমার অফিসের সহকারী শিক্ষা অফিসার শাহ আলমের নির্দেশে শিক্ষক সমিতির নেতারা অফিস খরচ বাবদ কিছু টাকা তুলেছে। তবে স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের নিকট থেকে টাকা উঠানো ঠিক হয়নি।
এঘটনায় জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ রুহুল আমিনের সাথে মুঠো ফোনে কথা হলে তিনি শ্যামনগর উপজেরা শিক্ষা অফিসের দূর্নীতির ব্যপারে বক্তব্য দিতে অনিহা প্রকাশ করেন।
শ্যামনগরের সূশীল সমাজের নেতৃবৃন্দরা বলেন, শিক্ষকরা জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষা অফিসারদের দূর্নীতিতে শিক্ষক নেতাদের সহযোগীতায় অপকর্মে লিপ্ত হওয়ায় শিক্ষক সমাজের মুল্যবোধ ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা আরো বলেন, যদি কেউ দূর্নীতি করে আর সেই দূর্নীতিতে কেউ যদি সহযোগীতা করে তাহলে সেও একই অপরাধের শামিল।