সারাদেশে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ফেরতদের নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব এলাকার বাসিন্দারা পালিয়ে কিংবা চোরাইপথে নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করছেন। মালবাহী ট্রাক বা ভাড়া করা মাইক্রোবাসে করে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ছাড়ছে লোকজন। নদীপথেও ছড়িয়ে পড়ছে কেউ কেউ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দাদের মাধ্যমেই সারাদেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরতদের নিয়ে গ্রামের বাসিন্দারাও আতঙ্কিত। প্রশ্ন উঠেছে, লকডাউন করার পরেও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দাদের আটকানো যাচ্ছে না কেন?
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা ঢাকার প্রত্যেকটি প্রবেশপথে পুলিশের চেকপোস্ট স্থাপন করেছি। মানুষকে মুভমেন্ট থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছি। তারপরও কেউ কেউ মিথ্যা কথা বলে বা জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে ঢাকা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমরা সবাইকে যার যার ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছি।’
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, নারায়ণগঞ্জে এক কোটি লোকের বসবাস। বেশিরভাগই বিভিন্ন জেলার মানুষ। লকডাউনের আগেই অনেকে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে গেছে। লকডাউন ঘোষণার পর আমরা সব রাস্তা বন্ধ করে রেখেছি। তারপরও বিভিন্ন অলিগলি দিয়ে অল্প কিছু লোক হয়তো যাচ্ছে। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। লোকজনকে বুঝিয়ে যে যেখানে আছেন সেখানেই অবস্থান করানোর চেষ্টা করছি।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ ভাড়াটিয়া বা বিভিন্ন জেলার মানুষ। কাজকর্ম বন্ধ থাকায় স্বল্প আয়ের মানুষেরা গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে। নিম্ন আয়ের বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষেরা একটি ঘরে গাদাগাদি করে থাকেন। তারা শুধু রাতের সময়টুকু ঘরে থাকতেন। লকডাউনের কারণে তারা সারা দিন ঘরেও থাকতে পারছেন না। এ কারণে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে মানুষের নিজের সচেতন হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
এদিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরতদের নিয়ে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আতঙ্ক শুরু হয়েছে। এসব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পুলিশ যৌথভাবে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকত বাধ্য করার চেষ্টা করছেন। বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে নানাভাবে লোকজন আসছেন। কোনোভাবেই তাদের আসা ঠেকানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে কারো কারো বাড়িতে লাল পতাকা লাগিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হচ্ছে। এলাকাবাসীও প্রশাসনকে সহযোগিতা করছেন।
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কে এম তরিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে কত লোক এসেছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তারা হাইওয়ে দিয়ে আসে না। বিভিন্ন পথ দিয়ে ঢুকে। আমরা তাদের নিয়ে শঙ্কিত। তবে আমরা যেটা করছি, তা হলো স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মাধ্যমে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ফেরতদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে বাড়িগুলোতে লাল পতাকা টানিয়ে দিচ্ছি। তারা যেন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকে সেই ব্যবস্থা করছি।
তিনি বলেন, আজও কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে কিছু লোক এসেছে ফরিদপুর থেকে। আমরা তাদের থার্মাল স্ক্যানার বা থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করে দেখছি। যাদের উপসর্গ আছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। বাকিদের নিজ নিজ বাসায় হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।’
সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জে বিশ জন যাত্রী বহন করা একটি মাইক্রোবাস আটক করে স্থানীয় পুলিশ। তারা সবাই সরকারের নির্দেশ অমান্য করে সিলেট থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরছিলেন। পরে উপজেলা প্রশাসন তাদের সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য বাধ্য করেন। উপজেলার ৩নং শতগ্রাম ইউনিয়নে ঢাকা থেকে আসা এক তরুণ জানান, অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বন্ধুরা মিলে একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে এসেছেন। পথে তাদের কেউ বাধা দেয়নি। বাসায় আসার পর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নির্দেশে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকছেন।
৩নং শতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কে এম কুতুব উদ্দিন বলেন, আমাদের ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত ৩০-৩৫ জন ঢাকাসহ আশপাশের জেলা থেকে এসেছে। আমরা প্রত্যেকের বাড়িতে লাল পতাকা তুলে দিয়ে নাম-ঠিকানা ও তারিখ উল্লেখ করে স্টিকার সেঁটে দিয়েছি। আমরা নিয়মিত চৌকিদার দিয়ে তাদের নজরদারি করছি। তারা যেন হোম কোয়ারেন্টিনের নির্দেশনা ভঙ্গ করে বের না হয় সেজন্য নজরদারির পাশাপাশি বুঝিয়ে বলছি। তিনি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকজন আসা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সারাদেশের মানুষের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়বে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাসড়কগুলোতে বাস না চললেও পণ্যবাহী ট্রাক বা পিকআপ ভ্যান চলছে। পুলিশ ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রাক-পিকাপ ভ্যানগুলো মানুষ নিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চলে যাচ্ছে। সড়কে পুলিশ সদস্যরা যাত্রীবাহী যানবাহন আটকালেও পণ্য পরিবহনের কারণে ট্রাক বা পিকআপ ভ্যান আটকাচ্ছে না। এই সুযোগ নিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেকে আবার পুলিশি ব্যারিকেডের আগেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা পথ বা অন্যান্য উপায়ে বাড়িতে চলে যাচ্ছে।
পঞ্চগড় জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, পঞ্চগড়ে প্রবেশের চারটি সড়ক পথ রয়েছে। চারটি সড়কেই আমরা চেকপোস্ট বসিয়েছি। কিন্তু কেউ চলে এলে তাকে ফেরত পাঠানোরও কোনও উপায় নেই। তাদের বুঝিয়ে নাম-ঠিকানা তালিকা করে তাদের নিজ নিজ বাসায় হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করছি। একই তথ্য জানিয়েছেন নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, কেউ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বা অন্য কোনও আক্রান্ত এলাকা থেকে আসার খবর পাওয়ামাত্রই তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যবস্থা করছি।
জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রামের হাট-বাজারগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। গ্রামের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক থাকলেও নিজেরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছেন না। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। কিন্তু অনেকেই রাতের আঁধারে আসার চেষ্টা করছেন। ট্রাকে বা মাইক্রোবাসে লোকজন আসছেন। আমরা উপজেলার মনিটরিং সেল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা মেম্বারদের মাধ্যমে তাদের বাড়িতে রাখার চেষ্টা করছি। নারায়ণগঞ্জ থেকে যারা আসছেন তারা আমাদের জন্য একটা আতঙ্ক। কিন্তু স্থানীয় মানুষ আমাদের সহযোগিতা করছেন। সাধারণ মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সচেতনতার মাধ্যমেই করোনার বিস্তার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ড. মু: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রচুর লোক লুকিয়ে লুকিয়ে খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় প্রবেশ করছেন। কেউ নদী পথে আসছে, কেউ অ্যাম্বুলেন্সে গভীর রাতে আসছেন, পণ্যবাহী ট্রাকে আসছেন। তাদের ঠেকাতে খুলনার বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। কেউ যাতে বাইরে থেকে না প্রবেশ করেন সেজন্য বাধা দেয়া হচ্ছে। যারা চলে আসছেন তাদেও ক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা যাদের বিভিন্ন পয়েন্টে পাচ্ছি তাদের পুলিশ পাহারায় যার যার বাড়িতে পাঠিয়ে হোম কোয়ারেন্টিনে রাখছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ বিভাগে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ জন। তাদের অধিকাংশ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন। বাকিরা আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। এই অঞ্চলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে ইতোমধ্যে জামালপুর জেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে জামালপুর জেলা ইতোমধ্যে লকডাউন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা পুরোপুরি লকডাউন না হলেও লকডাউনের মতো অবস্থা। আমরা কড়া নজরদারিতে রেখেছি। নেত্রকোনা ও শেরপুরেও একই অবস্থা। বাইরে থেকে আসা মানুষজনের প্রবেশ ঠেকাতে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রাস্তা দিয়ে কাউকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আটকানো হচ্ছে, যারা আসছে তাদের হোম কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বরিশাল বিভাগে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, করোনাভাইরাসের হটস্পট হিসেবে যেসব অঞ্চল পরিচিত সেখান থেকে যারা আসছেন তাদের হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে। সড়ক ও নৌপথে চলাচল বন্ধ থাকার পরও কিছু মানুষ প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে বরিশালে প্রবেশ করছেন। সেই প্রবেশ ঠেকাতে টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া যারা ইতোমধ্যে প্রবেশ করেছেন তাদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৫ এপ্রিল রাজধানী ঢাকায় প্রবেশ ও ঢাকা থেকে লোকজনকে বের হওয়া বন্ধ করে পুলিশ প্রশাসন। এরপর প্রথম আক্রান্ত জেলা হিসেবে ৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলাকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপরও ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে লোকজনের যাতায়াত বন্ধ করা যায়নি।
সুত্র: বাংলা ট্রিবিউন