
জাতীয় ডেস্ক:
‘অনেক কষ্ট করে, টিউশনি করে, নিজের আয়ে ছেলেটা আমার পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে। সামান্য বেতনের চাকরি করে এক ছেলে দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে এ কোন বিপদে পড়ল ছেলেটা। বড় ভাইদের সালাম না দিলে গায়ে হাত তুলবে, এটা কোন ধরনের আচরণ! ব্যাকটি (সবাই) লেখাপড়া করতে গেছিস, ব্যাকটি ভালভাবে থাকবি, পড়ালেখা করবি। তা না করে সন্ত্রাসী আচরণ করা—এটা তো ঠিক না।’
কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেনের বাবা মফিজুর রহমান। রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের স্থাপত্য বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। বিভাগের কতিপয় জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন রিয়াদ। এরপর ওই দিন রাতেই দিনাজপুর ত্যাগ করে রিয়াদ ঢাকার বাড়িতে চলে যান। এর আগে ৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ডিন বরাবর লিখিতভাবে নির্যাতনের কথা জানিয়েছিলেন রিয়াদ।
রিয়াদের বাবা মফিজুর রহমান পরিবার নিয়ে ঢাকার মহাখালীর কড়াইল এলাকায় থাকেন। ঢাকার আইপি এইচ স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে ভর্তি হন রিয়াদ।
আজ শুক্রবার রিয়াদের মুঠোফোনে তাঁর বাবা মফিজুর রহমানের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। মফিজুর বলেন, ‘নিজে বেশি পড়ালেখা করতে পারিনি। অনেক বড় স্বপ্ন আমাদের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ও মেধায় অনেক ভালো। কোনো দিন ওর মতের বিরুদ্ধে আমরা কিছু বলিনি। রিয়াদ সব সময় তার ভালো–মন্দ নিজেই বিচার করেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে লিখিতভাবে তার অসুবিধার কথা জানিয়েছে। এখন বিষয়গুলোর সমাধান হলে, শিক্ষকদের কাছে আশ্বাস পেলে ছেলেকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাব।’
রিয়াদও একই কথা বললেন। তিনি বলেন, ‘এখনো স্যারদের ওপরে ভরসা রেখেছি। চেয়ারম্যান স্যার ও প্রক্টর স্যার ফোন করেছিলেন। ফিরে যেতে বলেছেন। বাবার সাথে পরামর্শ করে পরে সিদ্ধান্ত নেব।’
এর আগে রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানো চিঠিতে রিয়াদ লেখেন, ২৯ জানুয়ারি বিভাগের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াজেদ ভবনের তৃতীয় তলার ৩৩৬ নম্বর কক্ষে ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ডাকেন। প্রায় ১ ঘণ্টা ২৫ মিনিট তাঁদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। কান ধরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ওঠবস করাসহ মিলিটারি ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। রিয়াদ এর প্রতিবাদ করলে তাঁর গলা টিপে ধরেন একজন। খারাপ ভাষায় গালিগালাজ করেন। রাত ১০টায় বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা রিয়াদকে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বাঁশেরহাট এলাকার একটি ছাত্রাবাসে ডেকে পাঠান। পরদিন শহরের সুইহারি এলাকার পরিচিত এক বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দেখা করতে গেলে তাঁরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর হলেও স্থাপত্য বিভাগে এটা মানা হয় না। এখানে সিনিয়র-জুনিয়রদের সম্পর্ক আমলা-কামলা। একজন শিক্ষার্থী যদি বড় ভাইদের কথার অবাধ্য হন, তাহলে তাঁকে অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন অনেকেই। রিয়াদের ঘটনার পর থেকে কয়েকটি ব্যাচের আটজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা বলেন, নতুন ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে আসার পর অন্তত ছয় মাস এ ধরনের র্যাগিং চলে। অনেক সময় আবাসিক হলের ছাদে নিয়ে র্যাগ দেওয়া হয়। কখনো সেখানে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে পুরো ছাদের মাপ নিতে বলা হয়। বালতির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে নামতা পড়তে বলা হয়। শীতের মধ্যে খালি গা করে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করাসহ অনেক সময় মারধরও করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ ব্যাচের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াহিদ মুস্তফা বলেন, ‘র্যাগিং এখন তুলনামূলকভাবে অনেক কমেছে। আগে আরও বেশি ছিল। গত বছর আমার রুমমেটকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে হয়েছিল। যদি কোনোভাবে একটা ব্যাচের মধ্যে র্যাগিং বন্ধ করা যায়, তাহলে বিষয়টি পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। সবাই ভাবছে, আমি বড় ভাইদের কাছে র্যাগ খেয়েছি, সুতরাং আমিও র্যাগ দেব।’
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দাবি, র্যাগিং বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ১৬ শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে তাঁদের অভিভাবককেও চিঠি দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ৪ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটির প্রধান প্রফেসর বিকাশ চন্দ্র সরকার বলেন, ‘বিষয়টি অবগত হয়েছি, দ্রুত তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’