বেদনার প্রতীক নীল। কষ্ট রঙে ঘেরা,অস্পষ্ট একটি মুখ। তারই মাঝে সবুজ, হলুদ,লাল মিলে তিনটি পাতা। দুটি ভাজে দুটি শব্দ ”নিরন্তর প্রতীক্ষা”। লেখক- শেখ মফিজুর রহমান।
হ্যাঁ, এটি একটি কাব্যগ্রন্হ। ছড়াকার নাজমুল হাসান আমাকে বললো, সাতক্ষীরার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান এর একটি কাব্য গ্রন্হ প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। গ্রন্হ সম্পর্কে লিখিত অভিব্যক্তি প্রকাশের আমন্ত্রণও পেলাম। নিজেকে গর্বিত মনে হলো। কারণ আমি একজন কাব্য প্রেমিক। কাব্যগ্রন্হ সামনে এলেই প্রেমের ইচ্ছে জেগে ওঠে। যাই হোক “নিরন্তর প্রতীক্ষা”র সঙ্গী হয়ে বাড়ি ফিরলাম। রাতের খাওয়া শেষ। নির্জনতায় শুধু আমি আর “নিরন্তর প্রতীক্ষা” । প্রচ্ছদে রঙের গভীরে লুকিয়ে আছে অস্পস্ট এক ছবি। ছবিটি আর কারো নয়, আমাদের বিচারিক পরিবারের কর্তা শেখ মফিজুর রহমানের। অতি স্পর্শকাতর একজন মানুষ তিনি। মাগুরা থেকে গরীবের বন্ধু উপাধি নিয়ে সাতক্ষীরায় জেলা জজ হিসেবে যোগদান করেন ইং০৩.০৪.২০১৯ তারিখে। খুব অল্পদিনে জজিয়াতির পাশাপাশি তাঁর মধ্যে বিদ্যমান মানবতার সৌরভ আমাদেরকে স্পর্শ করলো। বাংলাদেশের সকল কারাবন্দি হাজতিদের প্রাতঃ নাস্তা তালিকায় এক চিমটি গুড়মাখা শক্ত বৃটিশ রুটি ছিল। সম্প্রতি ঐ বৃটিশ রুটির পরিবর্তে দিশীয় সুস্বাদু খিচুড়ি-সবজি বরাদ্দ সম্পর্কিত যে সরকারি প্রজ্ঞাপনটি জারী হয়েছিল- মুলতঃ তা ছিল শেখ মফিজুর রহমানের একক সংগ্রামের ফসল। অহায় নিঃস্ব, ভ‚মিহীন গরীবরা যাতে বিনা খরচে দ্রুত আইনগত সহায়তা পেতে পারে তার জন্য তিনি নিজে উপস্হিত থেকে জেলাব্যাপী লিগ্যাল এইডের কার্যক্রমকে ব্যাপক হারে বিস্তৃত করেছেন। এগুলোই তাঁর সৌরভ ও সৌন্দর্য।
নীল রঙের বিষাদে, নান্দনিক প্রচ্ছদ সজ্জায় তাঁর ‘নিরন্তর প্রতীক্ষা’য় এবার আমি মুখোমুখি হলাম ।
সাহিত্যের ছোট্ট একটি সংজ্ঞা আছে। “স্পর্শকাতর মানুষের হৃদয় অনুভ‚তির বহিঃপ্রকাশই হচ্ছে সাহিত্য”। যা তাঁর নিজস্ব ভাষায় শব্দের অবয়বে জন্ম হয় কবিতা, গল্প, উপন্যাস কিংবা অন্য কোন রূপে। মানুষ মাত্রই অনুভ‚তিশীল। হতে পারে সে
শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, গরীব, ম‚র্খ, সাধক, সুফি কিংবা অন্য কোন বিশেষ পরিচয়ের। মানব সভ্যতার দীর্ঘ ক্রমবিকাশে সাহিত্যের ভ‚মিকা অপরিসীম। জীব-জন্তু,বৃক্ষ-নদী, সাগর- মহাসাগর,আলো-আঁধার, চন্দ্র-স‚র্য, বাতাস-মাটি তথা পৃথিবীর সকল সৃষ্টিরই স্বতত্র একটি জীবন আছে, অনুভ‚তি আছে। তবে দৃশ্যত মানুষ ছাড়া অনুভ‚তি প্রকাশের কারো কোন ভাষা নেই। এ জন্যেই মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব।
স্হান, কাল, পাত্র, দেশ ভেদে পৃথিবীতে বসবাসকারী লক্ষ কোটি মানুষের আবেগ অনভ‚তি এক-অভিন্ন হলেও ভাষা প্রকাশে শব্দের ব্যবহার ভিন্ন হয়ে থাকে। মানুষ কাঁদে মানুষের জন্য, প্রকৃতির জন্য কখনো বা বন্য প্রাণীর জন্য।
‘নিরন্তর প্রতীক্ষা’র প্রচ্ছদে লেখকের স্পর্শকাতর মুখোচ্ছবি নৈর্ব্যক্তিক ভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। একজন কবি অন্যের কষ্ট আলিঙ্গনে মিলিত হয়। রক্তের সাথে চলে আবেগের তীব্র প্রজনন । অসংখ্য শব্দের ভ্রুণে একসময় কবি হয় সমৃদ্ধ। জন্ম দেয় নৈর্ব্যক্তিক কবিতা।
রাত তখন বারোটা। মুখোচ্ছবির হাত ধরে শুরু হলো আমার পদযাত্রা। কবিতার বাগানে পা দিতেই প্রথমে চোখে পড়লো বিচিত্র মানুষের ‘মুখোশ’। মুখোশের আড়ালে তাবদ মানুষের বিচিত্র যন্ত্রণা। যা এই সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। যেন শব্দ দিয়ে গড়া কবির নান্দনিক ভাস্কর্য।
সামনে এগুতেই সঙ্গী মুখোচ্ছবিতে হঠাৎ ‘স‚র্যের আলো’। রাতের নির্জনে স‚র্যকে দেখা পাবো ভাবিনি। স‚র্যের সাথে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর। কিন্তু নেই সামর্থ। স‚র্য প্রতিদিন ওঠে নামে মানুষের প্রেমে। অথচ জীবন ক্ষণস্হায়ী। স‚র্যের সাথে তাল হারিয়ে চিরদিন সে বাঁচেনা। তাই স্বল্পতম সময়ে ইতিবাচক কর্মযজ্ঞে অনন্তকাল বেঁচে থাকাই কবির আকুতি খুবই প্রাণবন্ত।
এ ভাবে চলতে থাকি কবির সাথে কাব্য বাগানে। একে একে দেখা হলো বাইশটি কবিতার সাথে। সমাজের বিচিত্র ব্যথা,বিচিত্র প্রেম, বিচিত্র স্বপ্ন, বিচিত্র চরিত্র কিংবা বিচিত্র রোগ-মহামারী যেন দাঁড়িয়ে আছে এক একটি কবিতা বৃক্ষ হয়ে। অতঃপর নিরন্তর প্রতীক্ষা’র বৃক্ষতলে জ্যোৎস্না মাখা শরীরে একটু বিশ্রাম ।
তারপর আবারও কবির মুখোমুখি হলাম। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, প্রগতির জন্য, হারিয়ে যাওয়া মানবতা পুনরুদ্ধারের জন্য কবির সুপ্ত কষ্টগুলোকে বাইশটি কবিতার গা ছুঁয়ে অনুভব করলাম । প্রতিটি কবিতা প্রাঞ্জল শব্দে মোড়া। মনে হয় অতি আপন। যেন আমার এবং আমাদের সকল কষ্টের কথা এবং আশার কথা বলে । এখানেই কবির সার্থকতা।
কর্মময় জীবনে জজিয়তির আসনে বসে তিনি যে রায়- ডিক্রি এবং আদেশ প্রদান করেন সাহিত্যের সংজ্ঞায় ওগুলো প্রত্যেকটি এক একটি উৎকৃষ্ট সাহিত্য বলে আমি মনে করি। কেননা বাদী-বিবাদী,
আসামী-ফরিয়াদি’র যাবতীয় কথা এবং স্বাক্ষ্য প্রমাণ স্পর্শকাতরতার কষ্টিপাথরে যাচাই হয়েই ঘোষিত হয়।
তাই আপেক্ষিক অর্থে বলবো, শেখ মফিজুর রহমান শুধু একজন কবি নয় বরং একজন উৎকৃষ্ট কথা সাহিত্যিক । কিছুদিন আগে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের নির্বাচন নিয়ে বিবাদমান পক্ষের মধ্যে অনভিপ্রেত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল যা তিনি একটি উৎকৃষ্ট আদেশ দ্বারা নিষ্পত্তি করেছিলেন। যাকে আমি উৎকৃষ্ট সাহিত্য বলতে চাই।
যাই হোক, আবারও ফিরে আসি কবির ‘নিরন্তর প্রতীক্ষা’য়। সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যথা বেদনায় কবির মর্ম স্পর্শকাতরা, নীল রঙের প্রচ্ছদে অর্ধাঙ্গীনির প্রেরণায় নতুন স‚র্য দেখার প্রতীক্ষা’য় কবির অস্পষ্ট মুখোচ্ছবি আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছে। ভাবনা এবং শব্দের ব্যবহারে যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানা পরিদৃষ্ট হয়েছে। রূপকথার মোড়কে, ভাবনা, ছন্দ, তাল-লয়ে প্রত্যেকটি কবিতা স্বতন্ত্রভাবে সমুজ্জ্বল। আমি বিশ্বাস করি এই কাব্য গ্রণ্হটি যে কোন পাঠকের উর্বর বোধে অনেক রসদ যোগাবে । প্রকাশনা উৎসব সার্থক ও সুন্দর হোক। কবিকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমানের কাব্যগ্রন্থ “নিরন্তর প্রতীক্ষা” নিয়ে আমার কিছু কথা
পূর্ববর্তী পোস্ট