
গরীবের বন্ধু সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান এর উদ্দেশ্যে আর্তি– এ্যাড. এখলেছার বাচ্চু
একজন আইনজীবি হিসেবে বিচার প্রার্থী মানুষের কাছাকাছি থেকে তাদের ব্যাথা বেদনা উপলব্ধি করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি নৈতিকতার জায়গা থেকে তাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার প্রতিকূল অনুষঙ্গগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য সৃজনশীল চিন্তাগুলোকে বিচার কার্যে নিয়োজিত সর্বোচ্চ আধিকারীর কাছে পৌঁছে দিতে আমার এই প্রয়াস।
সিভিল আইনে একটা মামলা রুজু করতে হলে মামলার আরজির সাথে আরজি বর্ণিত সংশ্লিষ্ট কাগজ পত্র, কোর্ট ফি এবং বিবাদীদের নামে সাধারণ ও রেজিষ্ট্রি সমন একসাথে গেঁথে দাখিল করতে হয়। মামলার চরিত্র ও প্রকারভেদে একটি মামলায় ২০০, ৩০০ জন বিবাদীর উপর সাধারন ও রেজিষ্ট্রি সমন দাখিল করতে হয়। এক একটি সমনের পেছনে প্রায় ৪০-৫০ টাকা বাদীকে খরচ করতে হয়। মামলা সেরেস্তায় দাখিল হওয়ার পর সাধারণ সমনগুলো সেরেস্তাদার এক বা একাধিক জারিকারক পিওনের কাছে হাওলা করে দেন। পিওন সে গুলো জারি করে জারির রিটার্ন নথীতে সামিল করেন। এটাই নিয়ম তথা ব্রিটিশ আমলীয় আইনের ধারাবাহিকতায় এখনো চলে আসছে।
যিনি মামলার বাদী তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় মামলা দাখিল করে আইনজীবী এবং আইজীবীর ক্লার্ক এর উপর ভরসা করে চুড়ান্ত বিচারের অপেক্ষায় থাকেন। একটি মামলা স্বাক্ষী বা চুড়ান্ত বিচারে যেতে কতকগুলো আইনি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। আর তা হলো: সমন জারী- জবাব দাখিল, ইস্যু গঠন, ৩০ ধারার তদবীর এবং এসডি। তারপর চুড়ান্ত শুনানী। এই ধাপগুলির মধ্যে বাদী/ বিবাদীর মৃত্যুজনিত কারণে কিংবা অন্যকোন অন্তর্বর্র্তি আদেশজনিত কারণে মিস আলীল, রিভিশান, সংশ্লিষ্ট আদালতের প্রতি অনাস্থাজনিত কারণে ২৪ ধারার মামলা ইত্যাদী মুল মামলার কার্যক্রমকে কিছুটা থমকে দিয়ে থাকে। নির্বাচন ট্রাইবুলাল আদালতে নির্বাচনী মামলার ক্ষেত্রে ১৮০ দিনের মধ্যে মূল মামলা এবং ১২০ দিনের মধ্যে আপীল মামলা নিষ্পত্তির আইনগত নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবতায় তার নজির খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন।
যাই হোক এবার ফিরে আসি মামলার প্রাথমিক স্তরে সমন জারীর কিছু সমস্যা নিয়ে। আমার কাছে প্রায়শ:ই মক্কেলের অভিযোগ আসে। মক্কেলের অভিযোগের কমন ভাষাটি সরাসরি তুলে ধরলাম – “উকিল সাহেব আমার মোকদ্দমার বয়স ৫ বছর হয়ে গেল, অথচ এখনো সমন জারীর পর্যায়ে, আমি কী ভাবে এ মোকদ্দমা চালাবো ?” মক্কেলের এমন প্রশ্নে আমি হতবম্ভ হয়ে আমার ক্লার্ককে ডেকে মক্কেলের অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাই। ক্লার্ক বলে,” সমন জারী না করলে আমার কী করার আছে।” এমন উত্তরে মানবিক কারণে আমি স্বশরীরে সেরেস্তাদার এর কাছে গিয়ে সমন জারী না হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করি। তখন উনি বলে বসেন ” সব সমনতো দাখিল হয়নি” কিংবা জারী কারক এখনো জারীর রিটার্ন দাখিল করেনি।” সেরেস্তাদারের এমন কথায় আমি যখন আমার ক্লার্কের উপর সমন দাখিল না করার হেতু জিজ্ঞাসা করি তখন ক্লাক বলে -“আমিতো সব সমন দিয়েছিলাম, এখন দেখছি নেই। তাহলে আবার সমন দিতে হবে।” যখন এমন অবসস্থায় পতিত হই তখন মক্কেলের মুখের দিকে তাকানো যায়না। তাই ঐ মক্কেলের মাঝে নিজেকে প্রতিসস্থাপন করি আর ভিষণ কষ্ট অনুভব করি। আর সেই কষ্ট থেকে পরিত্রাণের জন্য কিছু সৃজনশীল চিন্তা আমার মধ্যে দানা বেঁধেছে।
উল্লেখ্য যে, আমরা প্রায় পঞ্চাশ বছর ভৌগলিক স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আইন ও বিচার ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষকে ন্যায় বিচার প্রদানের ক্ষেত্রে বহুবিধ বাস্তব সমস্যা আজও আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। কিংবা সৃজনশীল আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সমাধানের পথে মনযোগী হতে পারিনি। কেন পারিনি এ প্রশ্নের উত্তর একটাই। আর তা হলো আমাদের পার্লামেন্ট সদস্যদের উদাসীনতা কিংবা দেশপ্রেম ও মানবিক মুল্যবোধের চরম ঘাটতি। ব্রিটিশদের অত্যাচারী মনোভাবাপন্ন সেই পাথুরে আইনের জাতাকলে আজ-ও আমরা ক্রমাগত পিষ্ট হয়ে চলেছি। এটা যেন দেখার কেউ নেই।
আমাদের সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান দেশের সমগ্র কারাবাসীর সকালের নাস্তায় সুস্বাদু খিচুড়ি যুক্ত করার আন্দোলনে সফলতা অর্জন সহ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং লিগ্যাল এইডের বিস্তৃত কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে গরীবের বন্ধু সহ মানবিক মুল্যবোধের কান্ডারী হিসেবে সাধারণ ও বিচার প্রার্থী মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। আমি মনে করি চাকরির সীমিত গন্ডির মধ্যে থেকেও দেশ এবং মানব প্রেমের টানে এমন অবস্থান সবাই গড়ে তুলতে পাওে না। তাই সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ শেখ ফফিজুর রহমান আমার কাছে সবসময় একটি প্রেরণার উৎস। আর সেই প্রেরণা থেকে আমার এই সৃজনশীল চিন্তার প্রকাশ।
আমি ইতোমধ্যেই দেওয়ানী কিংবা ট্রাইবুনাল মামলায় সমন সংক্রান্ত জটিলতায় দীর্ঘসূত্রিতা বিষয়ে আলোকপাত করেছি। এবার এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আমার কষ্ট থেকে নির্গত সৃজনশীল চিন্তাগুলো বিবেচনায় নেয়ার জন্য জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান এ উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি।
(ক) আরজি দাখিলের সময় সেরেস্তাদার ক্লার্কের কাছ থেকে প্রত্যেকটি বিবাদীর নামীয় সাধারণ ও রেজিষ্ট্রি সমন ফিরিস্তি আকারে বুঝ করে নেবেন এবং ফিরিস্তির একটি প্রাপ্তি স্বীকার পত্র সিল-সহি সহ এ্যাডভোকেট ক্লার্ক-কে প্রদান করবেন। ক্লার্ক সেরেস্তাদার কতৃক গ্রহনকৃত সমনের ফিরিস্তি নিজ ফাইলে সংরক্ষণ করবেন। কখনো সমন না পাওয়া গেলে ক্লার্ক সেরেস্তাদারের গ্রহণকরা সমন ফিরিস্তি প্রদর্শন করলে সেরেস্তাদার সমন হারানোর দায়ে দোষী সাব্যস্থ হবেনএবং সে ক্ষেত্রে নিজ খরচে ঐ সমন দেওয়ার ব্যবসস্থা করবেন।
(খ) প্রত্যেকটি বিবাদীর উপর সাধারণ ও রেজিষ্ট্রি সমন ফিরিস্তি আকারে দাখিল না হলে সেরেস্তাদার ঐ মামলা গ্রহণ করবেন না বা ফাইলিং স্লিপ দেবেন না।
(গ) সমন জারীকারক এর কাছে হাওলার ক্ষেত্রে সেরেস্তাদার অনুরুপ ভাবে ফিরিস্তিতে জারীকারকের সহি নিয়ে তা সংরক্ষণ করবেন এবং জারী কিংবা না জারীর রিটার্ন ঐ ফিরিস্তি অনুযায়ী পিওনের কাছ থেকে বুঝ করে নেবেন।
ঘ) জারীকারক পিওনকে আইন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জারী কিংবা না জারীর রিটার্ন দাখিল করার নির্দেশনা দিতে হবে। সমন জারীর ক্ষেত্রে পিওনের অবহেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গন্য করতে হবে।
উপরোক্ত সৃজনশীল চিন্তাগুলি নিছক মানবতার কল্যানে এবং দ্রুত ন্যায় বিচারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই বিচার প্রার্থী মানুষের কল্যানের কথা ভেবে একজন আইনজীবী তথা কোর্টস অফিসার হিসেবে আমার প্রেরণার উৎস সাতক্ষীরার জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান এর কাছে বিহিত ব্যবস্থা গ্রহনে আমার এই ছোট্ট আর্তি।