
সিরাজুল ইসরলাম, শ্যামনগর প্রতিনিধিঃ শামনগর উপজেলার খানপুর গ্রামে অবস্থিত রাজা প্রতাপাদিত্যের জাহাজ ঘাটা নৌদূর্গ। যমুনা-ইছামতি নদীর পূর্বপাড়ে এ জাহাজঘাটার রনতরী তৈরী ও মেরামোতের কাজ হতো। মুঘল আক্রমন প্রতিহত করতে রাজা প্রতাপাদিত্য শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। এখানে ছিল তার প্রধান কার্যালয় ও পোতাশ্রয়। জাহাজঘাটার একটি মাত্র ভবনভেঙ্গে-চুরে এখনও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। উত্তর-দক্ষিনে লম্বা এভবনটিতে ছয়টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে অফিস, মালখানা, শয়নকক্ষ ও ন্সানাগার ছিল। এই ভবনের একঅংশে কোন জানালা নাই। ছাঁদের গম্বুজে বড় বড় ছিদ্র। সেজন্য ঘরের মধ্যে প্রয়োজনীয় আলো প্রবেশ করে। ঐ ছিদ্রে স্ফটিক বা স্বচ্ছ কাঁচ বসানো ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। ঈশ্বরীপুরের হাম্মাম খানার সাথে এর কিছু সাদৃশ্য দেখা যায়। জাহাজ ঘাটার নির্মান করা হয়েছিল ষোল শতকের শেষ দশকে। কালিগঞ্জ থেকে শ্যামনগর যাওয়ার পথে মৌতলা পার হলেই খানপুর। পাকা রাস্তার পূর্ব পাশে এর অবস্থান জাহাজঘাটার পাশে নৌ-সেনাপতি ডুডলির নামানুসারে বর্তমান দুদলী গ্রামে নৌকা, জাহাজ নির্মান ও সংরক্ষনের ডক ছিল।
আদি যমুনা নদী ইছামতি হতে উৎপত্তি। কালিগজ্ঞ-শ্যামনগরের মধ্য প্রবাহিত হয়ে মাদারনদী সাথে মিলিত হয় সোনাখালিএলাকায়। পরে মালঞ্চ হয়ে সাগরে যুক্ত হয়। প্রায় ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ এ নদীর সাথে ৫০ টির বেশী বিল ও ৫০ টি বেশী খালের সংযোগ রয়েছে। প্রবাহের ধারা ইছামতি-যমুনা-মাদার-মালঞ্চ-সাগর। মূলতঃ উপকুলীয় বাঁধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ পথ দিয়ে ইছামতির মিষ্টি পানি প্রবহ সাগরে এবং সাগেরের প্রবাহ ইছামতিতে আসা যাওয়া করতো। এ আসা যাওয়ার মাধ্য দিয়ে নদী ও সংযুক্ত খাল সমুহের নাব্যতা স্বভাবিক, পরিবেশ সহিষ্ণু ও খাদ্য নিরাপত্তা ঝুকিমুক্ত ছিল।আদি যমুনা নদী হলো সবচেয়ে ঐতিহ্য ও ইতিহাস খ্যাত নদী। বারোভুইয়ার অন্যতম স্বাধীন নৃপতি প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল এ যমুনা কুলে। এখনও টিকে আছে নৌপ্রতাশ্রয় জাহাজ ঘাটা। সনাতনী ধর্ম বিশ্বাসীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব বারুনের ¯œান এ যমুনাতে হয়ে আসছিল। কিন্তু উপকুলীয় বাঁধ নির্মানে প্রবাহমান যমুনা নদীকে বন্ধ খালের পরিনত করে।ইছামতির কালিগজ্ঞের দমদম ও বসন্তপুর মধ্য এলাকা হতে শুরু হওয়া আদি যমুনা নদী দু কিলোমিটর পর নাজিমগজ্ঞের পার্শ্ব দিয়ে দক্ষিন মুখো বাঁকনিয়ে সাগর মুখে ধাবিত হয়েছে। নাজিমগজ্ঞের পাশ্বের এ বাঁক হতে সোজা পূর্ব দিক মুখ করে বৃটিশ সরকার আঠারো সালের মধ্যবর্তী সময়ে একটি সংযোগ খাল খনন করে। যেটি পরবর্তীতে কাকশিয়ালী নদী নামে পরিচিতি পায়। যোগাযোগের জন্য এ নদীটি কাটলেও পরবর্তিতে এ নদী উপকুলীয় অঞ্চলের নদীর প্রবাহ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তৈরী করে উপকুলীয় এলাকার আন্তঃনদী সংযোগ।
আদি যমুনা নদী হতে শুরু কাকশিয়ালী নদী হতে খনন কৃত খাল কাকশিয়ালি চম্পাফুল ইউনিয়নের উজরপুরের ত্রিমহনীতে গুতিয়াখালী ও হাবড়া নদীর সাথে যুক্ত করা হয়। ফলে এখানে তিনটি ধারার সাথে কাকশিয়ালি নদীর মাধ্যমে ইছামতি-যমুনার সংযোগ সংযুক্ত হয়। কাকশিয়ালির একটি ধারা গুতিয়াখালি নদীর সাথে মিশে ঘুরে দক্ষিন মুখরিতহয়ে কালিগজ্ঞের বাঁশতলা ও আশাশুনির শ্রীউলার মধ্যবর্তি নদী গলঘেসিয়ার সাথে মিশে খোলপেটুয়ার সাথে যুক্ত হয়। খোলপেটুয়া সাগর থেকে উঠে আসা অন্যতম প্রধান জোয়ার ভাটার নদী।আর একটি ধারা উজিরপুরের নিকট হাবড়া নদীর সাথে মিলিত হয়ে উত্তর-পশ্চিম মুখো হয়ে দেবহাটার পারুলিয়ার ব্রীজের নীচ দিয়ে প্রবাহিত লাবন্যবতি নদীর সাথে মিলিত হয়। লাবন্যবতি নদী ইছামতির কোমরপুর (দেবহাটার) হতে উঠে আশা একটি প্রবাহমান সংযোগ নদী।
কাকশিয়ালীর অপর ধারা হাবড়া নদীর সাথে মিলিত হয়ে উত্তর-পূর্ব মুখি হয়ে বদরতলা, শোবনালী, ব্যংদহ হয়ে মরিচাপের সাথে যুক্ত হয়। মরিচ্চাপ সাগরযুক্ত খোলপেটুয়ার সাথে মিলিত প্রবাহমান নদী। অন্যদিকে মরিচাপ নদীর সাথে সাতক্ষীরার বেতনা নদীর সংযোগ আগে থেকে ছিল উঠে। পরবর্তিতে প্রান সায়ের খনন করা হলে এ সংযোগ আরো গতিময় হয়। ইছামতি, বেতনা, মরিচ্চাপ, খোলপেটুয়া, লাবন্যবতী, যমুনা, পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে এ অঞ্চলের নদীর প্রবাহের মধ্যে একটি আন্তঃসংযোগ রেখে এলাকাতে একটি সৃজনশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থা নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠে। এক নদী জোয়ার যখন অন্যটায় ভাটা। আর এভাবেই নদী সমুহে সকল সময় জোয়ার-ভাটার প্রবাহ থাকায় শুধু প্রধান নদী নয় অভ্যন্তরিন সকল নদী খাল সচল ও গতিশীল ছিল। কিন্তু উপকুলীয় বাঁধ নির্মান করার সময় এ নদী সমুহের প্রবাহ বিবেচনা না করে, নদীর পানির সাথে আসা পলি ব্যবস্থাপনার বিষয় এবং এলাকার প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা বিবেচনা না করে অপরিকল্পিত ভাবে বাঁধ ও স্লুইজ গেট নির্মান করে এ অঞ্চলের নদীর প্রবাহ ধ্বংশ করা হয় । উপকুলীয় অঞ্চলকে নিক্ষেপ করা হয় এক বৈরী পরিবেশের মধ্যে। নষ্ট হয় খাদ্য নিরাপত্তা বলয় । আদি যমুনা নদী শুধু শ্যামনগর কালিগজ্ঞের উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের নদী নয়, আজ সাতক্ষীরার ৫টি উপজেলার খাদ্য নিরাপত্তা ও পানি প্রবাহের একমাত্র সম্ভাবনাময় ধারা। আর এ বাস্তবতার নিরিখে আদি যমুনা নদীর প্রবাহর বিষয়টি আজ বিবেচ্যনা করা গেলে ইছামতি-যমুনার প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে এলাকা ঝুঁকিতে থাকা প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করা অনেকাংশে সম্ভব। এ সংগে ইছমতির কোরপুরের নিকট নির্মিত স্লুইজগেটটিও পরিবর্তন করে প্রবাহ স্বাভাবিক চলাচলের ব্যবস্থা করলে সামগ্রিক সাতক্ষীরা নিরপদ হতে পাওে জলাবদ্ধতার হাত থেকে। শ্যামনগর-কালিগজের জলাবদ্ধতা নিরসন ও জীবন জীবিকা নিরাপদ করতে আদি যমুনা দখল মুক্ত করার আন্দোলন শুরু। প্রাকৃতিক সম্পদে জনসাধারনের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা সামাজিক আন্দোলন আজ একটি সফল প্রচার মূলক কার্যক্রম । ২০০৫ সাল থেকে শুরু এ আন্দোলন করতে যেয়ে নানান প্রতিকূলতার সম্মুখিন হতে হয়। মোকবেলা করতে হয় অনেক অকাংক্ষিত ঘটনার। ৪০টারও বেশি মামলা, জেল ও গুমসহ নানা হয়রানী মূলক কার্যক্রমের শিকার হয় আন্দোলনকারীরা, বিশেষ করে যমুনা বাঁচাও আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দ। প্রতিপক্ষরা ছিল অত্যন্ত ক্ষমতাধর এবং প্রশাসনের আর্শিবাদ পুষ্ট। কিন্তু শত প্রতিকূলতা শর্তেও আদি যমুনা নদী সাধারনের প্রবেশাধীর আজ অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্ট আন্দোলন কারীদের পক্ষে রায় দিয়েছে। দখল হয়ে যাওয়া নদী দখল মুক্ত হয়েছে। নদী খনন করা হয়েছে সরকারী অর্থে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ দিয়ে যে যমুনা-মাদার নদী সংযোগস্থলে (শ্যামনগরের চিংড়ীখালী এলাকা) নদী আটকে দিয়ে উপকুলীয় বাঁধ নির্মান করে প্রবাহ বন্ধ করে দেয়, বর্তমানে সেই বাঁধ কেটে পানি প্রবাহের পথ তৈরী করেছে আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে।
বর্তমানে যমুনা বাচাও আন্দোলন কমিটি শ্যামনগর-কালিগজ্ঞের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদী প্রবাহ বাঁধা মুক্ত করতে আন্দোলন শুরু করে। চলমান আন্দোলন আজ সফলতার পথে। যমুনা বাঁচাও আন্দোলন কমিটির প্রধান দাবী ছিল খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা স্বাভাবিক করতে শ্যামনগর সদরের শশ্মান ও ঈদগাহর সামনের সড়ক ও জনপথ বিভাগের এর সড়কে ব্রিজ নির্মান করা এবং শ্যামনগর সদরে আদি যমুনা নদীর উপর নির্মিত তিনটি সংযোগ রাস্তায় পাইপ বসিয়ে তৈরী কালভার্ট পরিবর্তন করে নদীর প্রস্থতার সমান বেইলী ব্রিজ তৈরী করা। এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে সাগরের সাথে ইছামতি প্রবাহ আদি যমুনা নদীর মাধ্যমে সংযুৃক্ত হবে। ইতোমধ্যে শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন তিনটির দুটি রাস্তায় বেলী ব্রিজ নির্মান কাজ শুরুকরেছে। বাকী সংযোগ সড়কেও একই ধরনের ব্রীজ তৈরী হবে। আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবী অনুযায়ী শ্যামনগর শশ্মান ও ঈদগাহর সামনের সড়ক ও জনপথ বিভাগের এর সড়কে পুর্ণাঙ্গ ব্রিজ নির্মানের কাযক্রম দ্রুত শুরু হবে। যমুনা বাঁচাও আন্দোলন কমিটির উদ্যোগে ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা-৪ এর সংসদ সদস্য, শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কালিগ্ঞ উপজেলা চেয়াম্যান, পানি উন্নয়ন বোর্ড (শ্যামনগর ও কালিগজ্ঞ) এর সাথে লবি মিটিং ও দাবী নামা নিয়ে কথা হয়েছে। ইতোমধ্যে পথ যাত্রা করে সকলকে আবারও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়, যাতে করে প্রশাসনের উদ্যোগে ভাটা না পড়ে।
আদি যমুনা নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা সাতক্ষীরার জলাবদ্ধতা নিরসন, খাদ্য নিরাপত্তা সৃষ্টি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক তথা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র সংরক্ষনে জরুরী। একমাত্র কালিগজ্ঞের বসন্তপুরের ইছামতি-যমুনার এ জায়গায় পাউবো বাংলাদেশ পাড়ে বাঁধ নির্মন করেনি। ফলে এ স্থানটি উম্মুক্ত আছে। ফলে এ উম্মুক্ত স্থান দিয়ে ইছামতির প্রবাহকে দিয়ে সাতক্ষীরার নিন্মাঞ্চলকে সংকট মুক্ত করা সহজতর। তবে এক্ষেত্রে প্রথম প্রয়োজন এ তিন ধারার নদীতে সাগরের যাওয়ার পথ বাধা মুক্ত করা। ও শাখরা কোমরপুরের স্লুইজ গেট অপসারন করে নদীর প্রবাহ সাভাবিক করা।