
অনলাইন ডেস্ক :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নিম্নআয়ের মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পুষ্টি মিশ্রিত চাল বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিল খাদ্য অধিদপ্তর। মুজিববর্ষ প্রায় শেষ হতে চললেও এ চাল বিতরণ শুরুই করতে পারেনি অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, খাদ্য অধিদপ্তরের চাল-গম বিতরণ-সংক্রান্ত ওএমএস, ভিজিডি বা পুরোনো খাদ্যগুদাম মেরামতের মতো যেসব কার্যক্রম চলছে, তার প্রায় সবগুলোতেই চলছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি। এসব চাল-গম নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরে একটি দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে। এমনকি যার কোনো আটার মিল নেই, তিনিও গম বরাদ্দ পাচ্ছেন।
গরিবের গমের জন্যও ডিলাররা সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মুজিববর্ষ উপলক্ষে খাদ্য অধিদপ্তর বিদেশ থেকে আমদানি করা পুষ্টি চাল দেশের ১০০টি উপজেলার দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণের উদ্যোগ নেয়। ১০০টি সাধারণ চালের মধ্যে একটি পুষ্টি চাল মিশিয়ে তৈরি এসব চাল খাদ্য অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার্ড ডিলারদের মাধ্যমে বিতরণ করার কথা।
ডিলাররা প্রতি কেজি সাড়ে আট টাকা দরে চাল সংগ্রহ করে বিক্রি করবেন ১০ টাকা দরে। এ কাজের জন্য ডিলাররা অধিদপ্তর থেকে পরিবহন খরচসহ নির্ধারিত কমিশনও পাবেন। অথচ পুষ্টি চাল তো সংগ্রহ দূরে থাক, এ নিয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়নি খাদ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কর্তৃপক্ষ পুষ্টি চাল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে অসাধু পন্থা বেছে নিয়েছে।
ভিজিডি প্রকল্প থেকে কিছু পুষ্টি চাল নিয়ে মুজিববর্ষের কথা বলে ৩০টি উপজেলায় অল্পস্বল্প বিতরণ করা হয়েছে। একই কথা বলেছেন কয়েকজন ডিলারও। সমকালকে তারা বলেন, তাদের কয়েকজনকে তথ্য গোপন রাখার শর্ত দিয়ে ভিজিডি থেকে কিছু পুষ্টি মিশ্রিত চাল ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু উপজেলায় বিতরণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে টনপ্রতি তাদের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। অথচ ভিজিডি প্রকল্পের আওতায় এই চাল বিনামূলে দেওয়া হয়। বিনামূল্যের সেই চাল টাকার বিনিময়ে ডিলারদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, পাশাপাশি কর্মকর্তারা উৎকোচও নিচ্ছেন।
এমন অভিযোগের বিষয়ে পুষ্টি চাল সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খাদ্য অধিদপ্তরের উপসহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, উৎকোচ নেওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। আর মুজিববর্ষের পুষ্টি চাল কেনার জন্য দুটি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বাকি বিষয়ে তিনি মহাপরিচালকের (ডিজি) সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি সারোয়ার মাহমুদ সমকালকে বলেন, গত মার্চ-এপ্রিলে পুষ্টি চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল। হঠাৎ করে করোনা মহামারি শুরু হলে সব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এখন চেষ্টা চলছে আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে পুষ্টি চাল সংগ্রহ করে বিতরণের।
ডিলার ও অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব ডিলার পুষ্টি চাল মিশ্রণের জন্য মিল স্থাপনের আবেদন করতেন, সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও তাদের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা করে উৎকোচ নেওয়া হতো। এসব বিষয় ধরা পড়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে মিল স্থাপনের অনুমোদনের জন্য সম্প্রতি একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনাল, খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দিয়ে ওই কমিটি গঠনের পর এ খাতে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
গম নিয়ে কেলেঙ্কারি :খাদ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত আটার মিল মালিকরা মিলের সক্ষমতা অনুযায়ী অধিদপ্তর থেকে প্রতি মাসে ১০০ থেকে ৫০০ টন গম বরাদ্দ পান। মিলাররা সেই গম ভাঙিয়ে ২২ টাকা দরে ওএমএসের মাধ্যমে বিক্রি করেন। বেশিরভাগ মিলার সেই গম না ভাঙিয়েই সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ওই গমের প্রতি কেজির বাজারমূল্য অন্তত ৩০ টাকা। ডিলাররা পান ভর্তুকি মূল্যে ২০ টাকা দরে।
একাধিক মিল মালিক ও খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, কয়েক ব্যক্তি এই গম বরাদ্দের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। তারা মিল মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে এসব গম উত্তোলন করে সরাসরি খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। বিনিময়ে মিল মালিকদের কিছু টাকা ধরিয়ে দেন।
অভিযোগ আছে, এসব গম তুলতেও টনপ্রতি এক হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। প্রতি মাসে অধিদপ্তর থেকে ৩০ থেকে ৩২ হাজার টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ওএমএসের মাধ্যমে আটা তেমন বিক্রি হতে দেখা যায় না। আর টনপ্রতি এক হাজার টাকা হারে উৎকোচ হিসেবে অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তাদের মাসে বাণিজ্য হয় তিন কোটি টাকা। এই গম বরাদ্দের দায়িত্ব পালন করেন খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সরবরাহ ও বণ্টন) আমজাদ হোসেন, উপপরিচালক ওয়াজিউর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ। এ প্রসঙ্গে পরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি চাকরি করছেন। আর দেড় বছর চাকরি আছে। শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে এরকম অভিযোগ জমা পড়ছে। যখনই কেউ বরাদ্দ না পান, তখনই তিনি এমন অভিযোগ করেন।
মিল মালিকরা জানান, অনিয়ম নিয়ে কিছুদিন আগে তারা খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। তখন অভিযুক্তদের ডেকে মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেন ডিজি সারোয়ার মাহমুদ। পরে তিনি মিল মালিকদের ডেকে জানিয়ে দেন, তাদের (অসাধু ব্যক্তি) সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তারা ওয়াদা দিয়েছেন, নিজেদের সংশোধন করে নেবেন।
এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য ডিজির কার্যালয়ে গেলে তিনি অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন ও হারুন অর রশিদকে ডেকে পাঠান। তাদের বলেন, ‘আগেও আপনাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এসেছে। আমি আপনাদের আবারও সতর্ক করে দিলাম। বাকি চাকরিজীবনটা অন্তত ভালোভাবে থেকে মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বিদায় নেন।’
সম্প্রতি এসব বিষয় নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের উপপরিচালক সৈয়দ তাহছিনুল হক। মিলারদের পক্ষ থেকে দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, খাদ্য ভবনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মহৎ উদ্যোগ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিশ্চিত করার কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। হারুন অর রশিদের চাকরি মাত্র ১৮ মাস হলেও ইতোমধ্যে তিনি গাইবান্ধায় নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
একাধিক মিল মালিক জানান, খাদ্য অধিদপ্তরের পিয়ন অলির মাধ্যমে এসব উৎকোচ আদায় করা হয়। যারা সরাসরি দেখা করতে পারেন না, তারা অলির মোবাইল ফোন নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠান। কখনও কখনও বিভিন্ন এজেন্টের নম্বর দেওয়া হয় টাকা পাঠানোর জন্য। এ বিষয়ে ডিজি সারোয়ার মাহমুদ এই প্রতিবেদকের সামনেই হারুন অর রশিদের কাছ জানতে চান। হারুন অর রশিদ বলেন, ‘মিলাররা যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তখন কেউ এক-দুইশ টাকা অলিকে দেন। কিন্তু বিকাশে টাকা পাঠানোর কোনো কথা জানা নেই।’ এর পরই সারোয়ার মাহমুদ তাকে (পিয়ন অলি) অন্য শাখায় বদলি করার নির্দেশ দেন।
পুরোনো খাদ্যগুদাম মেরামত প্রকল্পেও কমিশন :সারাদেশে ৫৩৪টি পুরোনো খাদ্যগুদাম, ৪৭টি নতুন অবকাঠামো ও এক লাখ বর্গকিলোমিটার রাস্তা সংস্কারের জন্য ২০১৮ সালে ‘সারাদেশে পুরোনো খাদ্যগুদাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদির মেরামত এবং নতুন অবকাঠামো নির্মাণ’ প্রকল্প হাতে নেয় খাদ্য অধিদপ্তর। বরাদ্দ করা হয় ৩১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
দুই বছর পেরিয়ে গেলেও ২৫ ভাগ কাজও শেষ হয়নি। ঠিকাদারদের অভিযোগ, প্রকল্প পরিচালক হুমায়ুন কবিরের কমিশন বাণিজ্যের কারণে তারা কাজ করতে পারছেন না। বিল পাওয়ার আগেই তাকে ১০ শতাংশ কমিশন না দিলে তিনি বিল আটকে দেন, নানাভাবে হয়রানি করেন। তাদের আরও অভিযোগ, প্রকল্পের ব্যয় ৩১৬ কোটি ৮৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, কেউ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তাকে ফাঁসাতে এসব অভিযোগ করছেন। দুই বছর প্রকল্পের প্রায় ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তবে যে কাজগুলোর ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে, তার ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত ১৩ আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ৭৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের টাকা ও সময় বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আশা করি এর মধ্যে সব কাজ সম্পন্ন করতে পারব।
এ প্রসঙ্গে খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি সারোয়ার মাহমুদ বলেন, অনেক সময় ঠিকাদারের সঙ্গে দরপত্র আহ্বানকারীর মধ্যে সুসম্পর্ক থাকে, আবার বৈরী সম্পর্কও তৈরি হয়। এর দুটো কারণ থাকতে পারে- দু’জন যখন সুবিধা নেয়, তখন সুসম্পর্ক থাকে। আবার এমনও হতে পারে, ঠিকাদারের কাছ থেকে কাজটা সুন্দরমতো আদায় করে নিতে চাইছেন; কিন্তু ঠিকাদার করছেন না। তখন বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রেও হয়তো কোনো একটা হয়েছে। যখনই কারও স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তখনই অভিযোগ দেন। তবে অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্টভাবে পেলে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়।
সূত্র-সমকাল