
রোজার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩)। তাকওয়া হলো এমন এক সদাসতর্ক মানসিক অবস্থা, যা কাঁটাময় পথে পথিককে বাঁচাতে সাহায্য করে। তাকওয়া থাকলে মানুষ সব নিষিদ্ধ ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকবে এবং সব আদিষ্ট কাজ পালন করবে। রোজা বিভিন্নভাবে তাকওয়া সৃষ্টি করে। প্রথমত, রোজা হলো লৌকিকতামুক্ত ইবাদত। দ্বিতীয়ত, রোজা দ্বারা প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও সংযমের প্রশিক্ষণ হয়। তৃতীয়ত, রমজান মাসের ২৪ ঘণ্টা চলে ইবাদতের অনুশীলন। চতুর্থত, রোজার মাধ্যমে প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা দুর্বল হয়। পঞ্চমত, রোজা একটি সংবেদনশীল সমাজ গঠনে সাহায্য করে; কারণ সারা দিন উপবাস থেকে রোজাদার গরিব-দুঃখীর কষ্ট বুঝতে সক্ষম হয়। তাকওয়ার বৈশিষ্ট্য ছয়টি, ১. সত্যের সন্ধান, ২. সত্য গ্রহণ, ৩. সত্যের ওপর সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা, ৪. আল্লাহভীতির মহান স্বভাব সৃষ্টি করা, ৫. দায়িত্বসচেতনতা, ৬. আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ভয় নিয়ে সব কাজ সম্পাদন করা।
রমজান মুসলমানদের জীবনে পরিবর্তন আনার মোক্ষম সুযোগ। রোজা নিছকই উপবাস থাকা, পানাহার ও কামাচার বর্জনের নাম নয়; এর বিশেষ তাৎপর্য ও দর্শন রয়েছে। রয়েছে এর দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উপকারিতা।
হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেকের সর্বদা প্রভাব বিস্তার করা উচিত। কিন্তু মানবীয় দুর্বলতার কারণে অনেক সময় বিবেকের ওপর মানুষের আবেগ প্রাধান্য লাভ করে। তাই আত্মশুদ্ধি ও আত্মজাগৃতির জন্য ইসলাম রোজাকে মৌলিক ইবাদতগুলোর অন্তর্ভুক্ত করেছে। রোজা রাখার দ্বারা মানুষের কুপ্রবৃত্তি ও আবেগের ওপর বিবেক পরিপূর্ণভাবে বিজয়ী হয়। এতে তাকওয়ার গুণাবলি অর্জিত হয়। রোজা রাখার মাধ্যমে মানুষের নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা এবং আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও কুদরতের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। রোজার মাধ্যমে অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়, দূরদর্শনের ধারণা প্রবল হয়। আসবাব ও উপকরণের হাকিকত খুলে যায়। পাশবিকতা ও পশুত্ব অবদমিত হয়। ফেরেশতাদের নৈকট্য লাভ হয়। আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের সুযোগ হয়। অন্তরে মানবিকতা ও সহমর্মিতার বন্যা বয়ে যায়। রোজা দেহ-আত্মার সুস্থতার কারণ। রোজা মানুষের জন্য এক রুহানি খাদ্য, যা পরকালে মানুষের জন্য খাদ্যের কাজ দেবে। সর্বোপরি রোজা আল্লাহর ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন।’ (আহকামে ইসলাম আকল কি নজর মে, পৃষ্ঠা ১৪৩-১৪৫)
প্রকৃতপক্ষে দুটি বিপরীত বস্তু দেহ ও মনের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। দেহ মাটির তৈরি। আর রুহ বা আত্মা আল্লাহর হুকুম বা নূরের তৈরি। মাটি নিম্নগামী আর রুহ ঊর্ধ্বগামী। মাটির বৈশিষ্ট্য যখন মানুষের মধ্যে প্রবল হয়, তখন সে মনুষ্যত্বটুকুও হারিয়ে ফেলে। বরং চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে যায়। অন্যদিকে আত্মার শক্তি যখন তার মধ্যে প্রবল হয়, তখন সে মারেফতে এলাহি অর্জনে সক্ষম হয়। এমনকি উৎকর্ষের বিচারে ফেরেশতাকুলকেও ছাড়িয়ে যায়। মানুষ পশু নয়, নয় তো ফেরেশতা। পশুসুলভ গুণ ও ফেরেশতাসুলভ স্বভাবের সমন্বয়ে মানুষের সৃষ্টি। এ দুয়ের দ্বন্দ্বও চিরন্তন।
মুসলিম দার্শনিক শাহ ওয়ালি উল্লাহ (রহ.)-এর মতে, ‘যখন প্রবল পশুসুলভ গুণ ফেরেশতাসুলভ গুণ প্রকাশের পথে বাধা দেয়, তখন তাকে গুরুত্ব দিয়ে অবদমিত করা জরুরি। আর পশুসুলভ গুণের প্রাবল্য, উন্নতি ও ক্রমবৃদ্ধি ঘটে পানাহার ও জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে। তাই পশুত্ব অবদমনে এই উপকরণগুলোর সংকোচনের বিকল্প নেই।’ (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, খণ্ড-২, পৃষ্ঠা ৪৮) সূত্র: কালেরকন্ঠ