
নগদ ও চেক মিলিয়ে সাদৌন হাম্মাদকে এ ঘুষের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫০ হাজার দিনার দেওয়া হয়েছে তার বাসায়। বাকি দেড় লাখ দিনারের চেক পরিশোধ করা হয়েছে এক সিরীয় মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে। কুয়েতে নিজের লেনদেন সহজতর করার জন্যই ওই মধ্যস্থতাকারীর শরণাপন্ন হন পাপুল। ওই সিরীয় নাগরিক কুয়েতে একটি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
কুয়েতে বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে দেশটির আরেক এমপি সালাহ খুরশিদকে নগদ তিন লাখ ৭০ হাজার কুয়েতি দিনার দেওয়া হয়। কয়েক ধাপে তার বাসায় গিয়ে এ অর্থ পরিশোধ করা হয়। গোপন তদন্তে উঠে এসেছে যে, তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি চক্র কুয়েতে মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। একজন কুয়েতি এমপির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে পাপুল এ কাজে ব্যবহার করেন।
প্রতারণার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকদের কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হতো। কুয়েতে কথিত চাকরির চুক্তির জন্য তাদের কাছ থেকে আড়াই হাজার থেকে দুই হাজার ৭০০ কুয়েতি দিনার করে নেওয়া হতো। অথচ আইন লঙ্ঘনের কারণে এই চক্রের প্রতিষ্ঠানটি তখন বন্ধ ছিল। কুয়েতে পৌঁছে বাংলাদেশি শ্রমিকরা বুঝতে পারতো ওই চুক্তি ছিল ভুয়া। অর্থাৎ তারা প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। পরে তাদের জোরপূর্বক এমপি পাপুলের মালিকানাধীন অন্য কোম্পানিতে কাজে লাগানো হতো।
ভিনদেশে গিয়ে ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার এই শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ না করে এবং উপযুক্ত থাকার ব্যবস্থা না করে অমানবিক কর্মপরিবেশে তাদের দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। কেউ আপত্তি করলেই তাদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো। তদন্তে দুই কোম্পানির কিছু কর্মীকেও সাক্ষী করা হয়েছে। সাক্ষীরা জানান, এমপি পাপুলের মালিকানাধীন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রসিকিউশন জানিয়েছে, ১৩ জুন পাপুলের বাসা ও প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি যৌথ মালিকানার ছিল। ওই তল্লাশিকালে সেখানে কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে থাকা কিছু চেক দেখতে পান কর্মকর্তারা; যাদের কেউ কেউ কুয়েতের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আমলা।
তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এমপি পাপুল প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে তার আয়ের কিছু উৎস গোপন করা হয়; যা তিনি মানবপাচারের মাধ্যমে উপার্জন করেছিলেন। লেনদেনের সুবিধার্থে সরকারি কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষ দেন তিনি।
জিজ্ঞাসাবাদের শুরুর দিকে এমপি পাপুল তার বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেন। তদন্তাধীন নানা ঘটনার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথাও অস্বীকার করেন তিনি। পরে তার বাসভবন ও প্রতিষ্ঠানে তল্লাশিকালে এ সংক্রান্ত নানা নথির খোঁজ পান কর্মকর্তারা। এরপরই পাপুল স্বীকার করতে বাধ্য হন, তিনিই প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত ম্যানেজার। তল্লাশিতে পাওয়া চেকগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য তৈরির কথাও স্বীকার করেন তিনি। তবে তার দাবি, ওই অর্থ দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল বেআইনি নয়; এমন প্রক্রিয়াগুলো যেন কর্মকর্তারা দ্রুত সম্পাদন করেন। নগদ অর্থের বিনিময়ে শ্রমিকদের কুয়েতে নিয়ে যেতে বাংলাদেশে অবস্থিত ট্রাভেল অফিসের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন পাপুল।
১৬ জুন সম্পূরক তদন্ত চলাকালে পাপুল তার লেনদেনের সুবিধার্থে যাদের ঘুষ দিয়েছিলেন; নিচে তাদের পরিচয় তুলে ধরা হলো।
০১. এমপি সাদৌন হাম্মাদ আল-ওতাবি। লেনদেন সহজতর করা এবং কুয়েতে বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য তার বাসভবনে গিয়ে নগদ ৫০ হাজার দিনার পরিশোধ করা হয়।
০২. এক সিরীয় মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে এমপি সাদৌন হাম্মাদকে বাকি দেড় লাখ দিনারের চেক পরিশোধ করা হয়। কুয়েতে নিজের লেনদেন সহজতর করার জন্যই ওই মধ্যস্থতাকারীর শরণাপন্ন হন পাপুল। ওই সিরীয় নাগরিক কুয়েতে একটি প্রতিষ্ঠানের ডেপুটি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালে ওই ব্যক্তি কুয়েত ত্যাগ করেন।
০৩. এমপি সালাহ আবদুলরেধা খুরশিদ। কুয়েতে বাংলাদেশি শ্রমিক নিতে দেশটির এই এমপি-কে নগদ তিন লাখ ৭০ হাজার কুয়েতি দিনার দেওয়া হয়। কয়েক ধাপে তার বাসায় গিয়ে এ অর্থ পরিশোধ করা হয়।
এর বাইরেও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়।