
বাণিজ্য ডেস্ক:
আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের আইনি অগ্রাধিকার নিয়ে বিদেশি জাহাজ মালিকদের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলছে। বাংলাদেশের ৮টি জাহাজের মাত্র ৯ শতাংশ পণ্য পরিবহনে সক্ষমতা থাকলেও তাদের ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের অধিকার দেয়া হয়েছে। এমনকি বিদেশি জাহাজগুলোকে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহন করতে গেলে আগেই অনুমতি নিতে হবে।
এ অবস্থায় আইন সংশোধনের জন্য সরকারের সঙ্গে চিঠি চালাচালি শুরু করেছে শিপিং এজেন্ট এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
বিশ্ব আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে সমুদ্রগামী বাংলাদেশি ৯৫টি জাহাজের অনুমতি থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৮টি কনটেইনারবাহী। আর বাকি ৮৭টি বাল্ক জাহাজ হিসেবে চাল-গম-চিনি এবং সিমেন্ট ক্লিংকারসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করে। কিন্তু পরিবহনের ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যান্ড ইন্টারেস্ট আইন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বাল্ক জাহাজ নিয়ে তেমন কোনো বিরোধ না থাকলেও সংকট সৃষ্টি হয়েছে কনটেইনারবাহী জাহাজের ক্ষেত্রে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, এসব পরিচালনার জন্য আসলে আরও বেশি পরিমাণে জাহাজ দরকার, যা আমাদের নেই। তাই ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন অ্যান্ড ইন্টারেস্ট আইন অনুযায়ী যদি দেশীয় জাহাজকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, তাহলে দেশের পুরো বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডই ভোগান্তিতে পড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, এই সংকটকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে দেশের আইন পরিবর্তন করা উচিত।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং-তাঞ্জুম পালাপাস-সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে বছরে অন্তত ৯০টি কনটেইনারবাহী জাহাজ চলাচল করছে। বাংলাদেশি পতাকাবাহী ৮টি জাহাজ মাত্র ৯ শতাংশ পণ্য পরিবহনে সক্ষম হওয়ায় বাকি ৯১ শতাংশ পরিবহন করছে বিদেশি মালিকানাধীন ৮২টি জাহাজ। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে দেশি মালিকানাধীন জাহাজকে ৫০ শতাংশ পণ্য পরিবহনের স্বাধীনতা যেমন দেয়া হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের পণ্য পরিবহন করতে চাইলে আগে থেকে অনুমতি পত্র নেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বিদেশি জাহাজ মালিকদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
সাইফ মেরিটাইম লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার আবদুল্লাহ জহির বলেন, একটি জাহাজ যখন সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা পোর্ট কেলাং থেকে আসবে, তখন তো সেটি খালি আসতে পারবে না। ঠিক একইভাবে আমদানি করা পণ্য আনলোড করার পর খালি যেতে পারবে না।
নতুন এই নিয়মে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়ে আইন সংশোধনের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিজিএমইএ-র ১৬ লাখ আমদানি এবং ১৪ লাখ রফতানি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এই ৩০ লাখ কনটেইনারের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার ৮৫০ টিইইউএস কনটেইনার দেশীয় পতাকাবাহী ৮টি জাহাজ দিয়ে পরিবহন হয়েছে।
বাংলাদেশি ৮টি জাহাজের পূর্ণ সক্ষমতা দিয়ে মাত্র ৯ শতাংশ পণ্য পরিবহন সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেই চিঠিতে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের পণ্যগুলো বহন করি, তাহলে মার্কেটিং বাড়াতে হবে। ফলে আমাদের জন্য কাজ করা সহজ হবে।’
বর্তমানে বিদেশি জাহাজের অনুমতিপত্র কিংবা ওয়েভার তিন দিনের মধ্যে পাওয়ার কথা থাকলেও তা পেতে ৫ থেকে ৬ দিন বাড়তি লাগছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় ওয়েভার পাওয়ার সময় ২৪ ঘণ্টায় নামিয়ে আনার অনুরোধ জানিয়েছে বিজিএমইএ।
উল্লেখ্য, বছরে ৩২ লাখ কনটেইনারের পাশাপাশি ১১ কোটি মেট্রিক টন পণ্য নিয়ে চার হাজারের বেশি জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে, যার মধ্যে ৯৫ শতাংশ জাহাজই বিদেশি মালিকানাধীন। আর এ ক্ষেত্রে দেশের মালিকানাধীন জাহাজের যেমন স্বার্থ সংরক্ষণ করতে হবে, তেমনি বিদেশি জাহাজ মালিকরা যেন বাংলাদেশের প্রতি কোনো রকম অসন্তুষ্ট না হয়, সেটিও দেখতে হবে সরকারকে।