
জাতীয় ডেস্ক:
ছোট্ট রাইদাহ গালিবাকে কাছের স্বজনেরা ডাকতেন ‘কুইন’ বলে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই সে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে নাম করেছিল। রাইদাহর কাছে পাণ্ডুলিপি চেয়ে নিয়ে বই প্রকাশ করতেন প্রকাশকেরা। এবারের অমর একুশে বইমেলাতেও রাইদাহ গালিবার ‘ভয়ংকর গাছ’ নামের একটি রূপকথার গল্পের বই এসেছে। এটি তার চতুর্থ বই। তবে রাইদাহ ছাপা বইটি দেখে যেতে পারেনি। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ১ ডিসেম্বর মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, তার চিকিৎসায় অবহেলা করেছিলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল রাইদাহ। মাত্র আট বছর বয়সে তার ‘বাঘ ও দৈত্য’ নামের একটি গল্প প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমির ‘ধানশালিকের দেশ’ পত্রিকায়। এরপর একাধিক গল্প প্রকাশিত হয় শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘শিশু’ পত্রিকায়। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের অমর একুশে বইমেলায় রাইদাহ গালিবার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলো হলো ‘পিটুর জাদু জুতা’, ‘এক যে ছিলো মুচি’, ‘ইমা ও দৈত্য’।
আগে বইমেলায় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে রাইদাহ মা–বাবা বা অন্যদের সঙ্গে হাসিমুখে উপস্থিত থাকত। এবার নেই। এবার তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনসহ অন্যরা।
রাইদাহর মা কথাসাহিত্যিক কানিজ পারিজাত বলেন, তিনি কখনোই মেয়ে কীভাবে লিখবে বা কোন বিষয়ে লিখবে, এ নিয়ে কথা বলতেন না। মা ও মেয়ের লেখালেখির জগৎ সম্পূর্ণই আলাদা ছিল। মেয়ের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে পৌঁছে দেওয়া বা পত্রিকায় জমা দেওয়া ছাড়া মা হিসেবে তাঁর আর তেমন কিছু ভূমিকা ছিল না।
কানিজ পারিজাত আক্ষেপ করে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মেয়েটা মুখে মুখে গল্প বলত। সেই গল্প সে কোথাও পড়েছে, তেমন নয়। জানতে চাইলে বলত, এইমাত্রই তার মনে এসেছে এ গল্পের কথা। মারা যাওয়ার আগেও বলেছিল, তার মাথায় ১২ থেকে ১৩টি গল্প ঘুরছে। কিন্তু মেয়েটি এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে, তা তো বুঝতে পারিনি। তাই তার গল্পগুলো বা এর আগের অনেক পাণ্ডুলিপি, আঁকা ছবি সেভাবে সংরক্ষণ করিনি। এখন আফসোস হচ্ছে, কেন সেগুলো সংরক্ষণ করলাম না। কেন জানতে চাইলাম না তার মাথার ভেতর থাকা গল্পগুলো কী নিয়ে ছিল?’
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) রেজিস্ট্রার বরাবর চিকিৎসকের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে গাফিলতির কারণে ডেঙ্গুতে একমাত্র মেয়ের মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর পরও চিকিৎসা বিষয়ে অসত্য তথ্য দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন তিনি।
রাইদাহ গালিবার আবরার মাহির নামের এক ছোট ভাই আছে। তার বাবা মিজানুর রহমান একজন ব্যবসায়ী। মারা যাওয়ার সময় রাইদাহর বয়স হয়েছিল ১২ বছর ১০ মাস।
গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর রাইদাহর মৃত্যুর তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও আবেদন করেন পরিবারের সদস্যরা। গত ৯ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (উন্নয়ন অনুবিভাগ) আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, কমিটি গঠিত হয়েছে বলে তাঁরা চিঠি পেয়েছেন, তবে এখনো তাঁদের ডাকা হয়নি। আর বিএমডিসি থেকে এখনো কোনো চিঠি বা কোনো তথ্য জানতে পারেননি।
এবারের বইমেলায় রাইদাহর বইটি প্রকাশ করেছে বইবাংলো প্রকাশন। বইটির প্রকাশক কাজী কামরুল হাসান। রূপকথাধর্মী বইটির পেছনে বইবাংলো প্রকাশনের পক্ষ থেকে একটি লেখায় রাইদাহর মৃত্যু নিয়ে পরিবারের যে অভিযোগ, তা উল্লেখ করা হয়েছে। স্থিতিশীল অবস্থায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পর দুই দিনের মাথায় বিভিন্ন অব্যবস্থাপনায় রাইদাহ মারা যায়। রাইদাহর সর্বশেষ ‘ভয়ংকর গাছ’ নামের বইটিকে এই খুদে লেখকের ক্ষুদ্র জীবনের অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ওই লেখায়। গল্পটিতে রাইদাহ যে ভয়ংকর গাছের কথা লিখেছে, সে গাছের কাছে গেলে প্রাণ সংহার হয়। নিষ্ঠুর পৃথিবীতে অচিরেই রাইদাহর প্রাণও সংহার হবে, রাইদাহ এটা বুঝতে পেরেছিল কি না—এ প্রশ্নও তোলা হয়েছে। বইটি ছোটরা পড়বে এবং রাইদাহকে ভালোবাসবে—এ আহ্বান জানিয়েছে বইবাংলো প্রকাশন। বইটির দাম রাখা হয়েছে ২০০ টাকা।
রাইদাহর মা কানিজ পারিজাত ও বড় খালা নুসরাত আইরীন প্রথম আলোকে বলেন, এবারের বইমেলায় রাইদাহর বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তাঁদের মনে হয়েছে, হয়তো রাইদাহ কোথাও থেকে দেখছে আর হাসি হাসি মুখে ভাবছে—এটাই তো আমার বই। বইটির বানান দেখাসহ চূড়ান্ত পর্যায়ের যাচাই-বাছাই করার দিনটিতেই রাইদাহ মারা গিয়েছিল।
পরিবারের সদস্যরা বলছেন, অভিযুক্ত চিকিৎসক যদি একটু আন্তরিক হতেন, ব্যবস্থাপনাটা সঠিক হতো, তাহলে হয়তো রাইদাহ এভাবে মারা যেত না। তার প্রকাশিত বইগুলো এখন পরিবারের সদস্যদের কাছে শিশুদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ার লড়াইয়ের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। রাইদাহর বইগুলো নাড়াচাড়া করে চোখের পানি ফেলে দিন কাটে স্বজনদের।
কানিজ পারিজাত বলেন, ‘আমার মেয়েটা সাবধানী বাচ্চা ছিল। বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন ও সংবেদনশীল ছিল। আইসিইউতেও জানতে চাইত, আমরা তার জন্য রক্ত জোগাড় করতে পেরেছি কি না। হাতের স্যালাইনের সুই খুলে গেছে বলে নিজেই অন্যদের সতর্ক করত। দুই দিন কষ্ট করলেই হাসপাতালের কেবিনে এবং পরে বাড়ি ফিরতে পারবে—এ আশায় সব কষ্ট সহ্য করেছিল মেয়েটা। কিন্তু চিকিৎসক যে আমাদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলেন, তা তো বুঝতে পারিনি। একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে চিকিৎসক চাপে পড়ে স্বীকার করেন, মেয়ের অবস্থা খারাপ। এর আগে বলেছেন, মেয়ে ভালো আছে, সব ঠিক আছে।’
রাইদাহর পরিবারের সদস্যরা বলেন, বড় হয়ে ক্রিকেটার ও লেখক হতে চেয়েছিল রাইদাহ। এর আগে লেখালেখির জন্য সম্মানীও পেয়েছে সে। তবে এবার মেলায় বইটি বিক্রি হচ্ছে কি না বা কত কপি বিক্রি হলো, এসব নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই রাইদাহর পরিবারের সদস্যদের। তাঁরা চান, রাইদাহর মৃত্যু নিয়ে তাঁদের করা অভিযোগের যথাযথ তদন্ত হোক, দোষী ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তি হোক। রাইদাহ আর ফিরবে না, কিন্তু আর কোনো শিশুর ভাগ্যে যাতে এমন চিকিৎসার অবহেলা না জোটে, এটাই চাওয়া পরিবার ও স্বজনদের।