মাসুদুর রহমান মাসুদ: বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরা। এ জেলার প্রাণ কেন্দ্র সাতক্ষীরা শহর। শহরবাসীর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে প্রতিদিনই কোন না কোন কাজে এই শহরে আসতে হয়।শহরের যানজটই সাধারনত মানুষকে বেশি ভোগান্তিতে ফেলে থাকে। কিন্তু বর্তনানে এক অদ্ভূত রকমের সমস্যার কবলে পড়েছে শহরবাসী সহ এখানে আসা জেলার বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন।
সাতক্ষীরা শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি সড়ক হলো পাকাপোল থেকে নারকেলতলা মোড় পর্যন্ত শহীদ নাজমুল স্মরনী সড়কটি। এই সড়কের পাশেই সাতক্ষীরার প্রানসায়ের খাল। খালটি দীর্ঘদিন যাবৎ ভরাট থাকায় পানি নিষ্কাশনে শহরবাসীর বেশ অসুবিধা হতো। এর দু’পাশ দিয়ে গড়ে উঠেছিল অবৈধ স্থাপনা। সাতক্ষীরা জেলা প্রশানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এই খালটি পূন: খনেনর কাজে হাত দেয়া হয়। পাশাপাশি এর দু’পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।ফলে সাতক্ষীরা শহর কিছুটা হলেও ভিন্নরুপে রুপ লাভ করে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও খাল পূন:খননের ফলে জনমনে স্বস্তি এলেও নতুন করে আরেক দূর্ভোগের শিকার হচ্ছে শহরবাসী। আর তা হলো ধূলার যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনায় গোটা শহরবাসী নাকাল হয়ে পড়েছে। পথচারীরা ঠিকমতো চলাচল করতে পাছে না, ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না, ধূলার কবলে পড়ে বাড়ছে নানারকমরোগ ব্যাধির ঝুঁকি-এমনই নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে শহরবাসী সহ জেলা শহরে সেবা নিতে আসা বিভিন্ন উপজেলার মানুষ। দিনের পর দিন এভাবে অতিবাহিত হলেও সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষের কোন খবর নেই বলে অভিযোগ ভূক্তভোগীদের। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে এ সমস্যা সমাধান করা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাতক্ষীরা প্রান সায়ের খাল পূন:খনন কাজ করার ফলে এই খালের মাটি বিক্রি করে দেয়া হয়। মূল সড়ক দিয়েট্রাক্টর করে খালের কাদামাটি বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় সড়কের বিভিন্ন যায়গায় তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এই কাদামাটি রৌদ্রে শুকিয়ে বর্তমানে ধূলা হয়ে বাতাসে উড়ছে। এর পাশাপাশি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করায় সেখানকার মাটি থেকেও ধূলা উড়ছে যা সড়কে চলাচলকারীদের শরীরে, নাকে-মুখে লাগছে। বাতাসের সাথে এই ধূলা বহগুনে ছড়িয়ে পড়ছে। তাছাড়া লক্কড়-ঝক্কড় এ সড়ক দিয়ে যখনই কোন প্রাইভেট কার, ট্রাক্টর, পিকআপ, ট্রাক তথা মালবাহী গাড়ী চলাচল করছে তখন এই ধূলা উড়ার পরিমান বহুগুণে বৃদ্ধি পাচ্ছে।ফলে এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী ভ্যান, রিক্সা, মোটরসাইকেল আরোহী সহ পায়ে হেটে চলাচলকারী লোকজন এবং রাস্তার দু’ধার দিয়ে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোকজন ও ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা ধূলা বালিতে আক্রান্ত হয়ে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জনপ্রতিনিধি, সংবাদকর্মী,বিভিন্ন পরিবহনের চালক সহ সর্বস্তরের মানুষ ধূলার কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত হাফিয়ে উঠছে। অফিস আদালতে যাওয়া লোকজন পরিস্কার কাপড় নিয়ে অফিসে তথা কর্মক্ষেত্রে পৌছাতে পারছে না। কখনো কখনো কারো কারো অবস্থা এমন হচ্ছে যে পাকা পোল থেকে ভাল কাপড়ে রওনা হলে নারকেল তলা মোড়ে পৌছাতে পৌছাতে তা নষ্ট ও ভিন্নবর্ন হয়ে যাচ্ছে।এ বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিতে গেলে এমনটাই দেখা যায়।যার ফলে অনেকেই ব্যঙ্গ করে বলছেন, এই সড়কে এতোই ধূলা উড়ছে যে, ধূলা ময়লার কারনে “সাদা কাপড় কালো না হলেও কালো কাপড় সাদা হয়ে যাচ্ছে”। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এ যেন এক আজব শহর। এ যেন ধূলার শহর।
শহরের এই ধূলার যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে অনেকেই নানা অভিযোগ-অনুযোগের কথাবলছেন। তুলে ধরছেন এর বর্তমান বাস্তব চিত্র।গত রবিবার (২৮ মার্চ) সকাল ১১টায় এই সড়কের নারকেল তলা মোড় সংলগ্ন এলাকায় গেলে দেখা যায়, ধূলার যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে রাস্তার ধারের কয়েকজন ব্যবসায়ী নিজ অর্থে শ্রমিক লাগিয়ে কোদাল ও ব্যালচা দিয়ে মূল সড়কের কাদামাটি চেঁচে উঠিয়ে ফেলছে। কারন জিজ্ঞাসা করলে তাদের একজন এ প্রতিবেদককে বলেন, ভাই; খালের কাদামাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার সময় এগুলো পড়েছে। এখন তা রোদে শুকিয়ে গাড়ীর চাকার সাথে উঠে বাতাসে উড়ছে। দোকানে বসে ব্যবসা করা যাচ্ছে না। প্রশাসনও কোন সমাধান করছে না। তাই অগত্যা আমরা নিজেরাই এ কাজ করছি।
এই সড়ক সংলগ্ন যমুনা টাইলস এর কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দীন বলেন, প্রতিনিয়ত ধূলা উড়ছে, ধূলার প্রকোপে দোকানে বসে ব্যবসা করতে পাছি না। তাই নিজেরাই রাস্তার ধূলা কাদামাটি সরানোর ব্যবস্থা করছি। এখানকার মারিফুল মাসুদ বিপুল নামের অপর একজন বলেন, ধূলার যন্ত্রনায় ব্যবসা করাই দায় হয়ে গেছে। দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতা আসছে না। ব্যবসায়ও মন্দা।
অপর ব্যবসায়ী আল কোরাইশী বলেন, ধূলা বালিতে দোকানে বসা যায় না। দোকানের সামনের রাস্তায় প্রতিদিন ৫/৭ বার করে পানি ঢালতে হয়। পৌরসভা বা জেলা প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে নিজস্ব উদ্যোগে শ্রমিক লাগিয়ে কাদা পরিস্কার করছি।
এই সড়ক সংলগ্ন বই ব্যবসায়ী রিপন বলেন, ধূলার কারনে ব্যবসা করতে পারছি না। সকাল ১১টার মধ্যে দোকানের বই পত্র ৮/১০ বার পরিস্কার করা হয়ে গেছে। এ যন্ত্রনার শেষ কোথায় জানিনা।
এই সড়কের ফুটপাতের কাপড় ব্যবসায়ী আজিজুর রহমান বলেন, নিজস্ব কোন দোকান না থাকায় জীবন জীবিকার তাগিদে আমি ফুটপাতে ব্যবসা করি। কিন্তু শহরের ধূলা ময়লায় কাপড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ময়লাযুক্ত কাপড় কিনতে ক্রেতা আসছে না। বেঁচা বিক্রিও তেমন হচ্ছে না। তাই পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ অসুবিধায় আছি।
চায়ের দোকনদার রুহুল আমিন বলেন, ধূলার প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে দোকানের সামনে পর্দা টানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাতেও রক্ষা হচ্ছে না। ধূলার কারনে কাস্টমার আসছে না। তাই আয় ইনকামও হচ্ছে না।
সেলুন ব্যবসায়ী উত্তম বলেন, খাল খনন করেছে সুবিধার জন্য কিন্তু সেসুবিধা পাওয়ার আগেই আরেক অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে।খালের মাটিতে শহর জুড়ে ধূলা উড়ছে। এ যেন খাল কেটে কুমির আনার মতো। তিনি আরও বলেন, সকাল থেকে দোকানের গ্লাস সহ সরঞ্জামাদি শুধুই মুচছি, কোন কাজ হচ্ছে না। ফলে কাস্টমার আসছে না, ব্যবসা হচ্ছে না। আয় নেই, বউ-বাচ্ছার খাবার যোগাড় করতে সমস্যা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভ্যান চালক ও দুই শিক্ষার্থী প্রায় একই সূরে বলেন, রাস্তা দিয়ে ঠিকমেতা চলাচল করা যাচ্ছে না। ধূলা বালিতে চোখ মুখ সহ সর্ব শরীর ভরে যাচ্ছে। কাপড় চোপড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই যখন শহরবাসীর মন্তব্য ও বাস্তবচিত্র তখন কর্তৃপক্ষ নাকে তৈল দিয়ে ঘুমাচ্ছে বলে অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেরই।
ইবনে সিনা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সকল রোগের মূল কারণ হলো ধুলা-বালু’। এই মনীষীর বাণী যদি সত্য হয়, তাহলে ধুলা বালু শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ বৃদ্ধি করছে, বাড়ছে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ। ধুলার কারণে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ নানা জটিল শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিমত চিকিৎসকদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় শহরের মানুষ ভুগছে ধুলা মিশ্রিত বাতাসে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সাধারন সম্পাদক হাফিজুর রহমান মাসুম বলেন, প্রাণ সায়ের খাল পূন:খনন কাজ চলছে, ২০২০ সালের জুনের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে তা শেষ হয়নি। শীত চলে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ড্রামট্রাক দিয়ে কাদামাটি পরিবহন করার কথা, ভালোভাবে পরিবহন করলে এই সমস্যার সৃষ্টি হতো না। কাজটি দীর্ঘ মেয়াদি হচ্ছে, সমগ্র রাস্তা জুড়ে শুধুই কাঁদা মাটি আর বাতাসে ধূলার ছড়াছড়ি। কেউ বাসা থেকে বের হলে আধা ঘন্টার মধ্যে তার কাপড় চোপড় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধূলার কারনে মানুষ শ^াসকষ্ট, এলার্জি সহ নানা রকম স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, খাল খনন অব্যস্থাপনায় সিভিল সোসাইটির লোকজন ও রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দ নিশ্চুপ থাকায় শহরবাসীকে আজ এই সমস্যার মুখোমুখী হতে হচ্ছে।এই সমস্যার জন্য মূলত: পানি উন্নয়ন বোর্ড, পৌরসভা ও জেলা প্রশাসন দায়ী। তাদের অদ্ভূত রকমের উদাসীনতায় আমরা বিস্মিত ও হতবাক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে জনগনের প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। সম্মিলিত প্রতিবাদ ছাড়া এ সমস্যার কোন সমাধান নেই।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, খাল কাটায় অব্যবস্থাপনার কারনে শহরবাসী এই সমস্যায় পড়েছে। এতে করে মানুষকে খুবই দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জনদূর্ভোগ লাঘবে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পৌর মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতির সাথে যোগাযোগের জন্য তার অফিসে গিয়েও কথা বলার সুযোগ না পেয়ে মোবাইলে তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে মোবাইলে কিছু জানাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।
তবে আশার কথা হচ্ছে, শহরবাসীর এই দূর্ভোগ লাঘবে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ইতোমধ্যে সভা করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই এই সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আলহ্জ¦ নজরুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, শহরের এই ধূলার সমস্যা সমাধানের জন্য ইতোমধ্যে সভা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে ৪৫ লক্ষ টাকার বাজেট ধরা হয়েছে। আপাতত চলাচল উপযোগী করার জন্য আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, জনগনের দূর্ভোগের বিষয়টি নিরসন করার জন্য ইতোমধ্যে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সভা হয়েছে।ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বলা হয়েছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু হবে। তার আগে রাস্তার ধূলা পরিস্কার করার ব্যবস্থা নেয়া হবে।জনদূর্ভোগ লাঘবে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।