২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথা এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৮ নং লক্ষ্য সবার জন্য শোভন কাজ নিশ্চিত করা। আইএলও’র এশিয়া প্রশান্ত মহসাগরীয় ১৬তম আঞ্চলিক সম্মেলনে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে শোভন কাজকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে।
আইএলও’র মতে, যে কর্মসংস্থান শ্রমিকের ন্যায্য আয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত উন্নয়নের সম্ভাবনা, পারিবারিক-সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তা-ই শোভন কাজ।
শোভন কাজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়, সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে, অর্থনীতিতে গতি আনে ও টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎস তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের জিডিপিতে শতকরা ১৮ ভাগ অবদান রাখে। এ খাতে শ্রম দিচ্ছে প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিক, যাদের মধ্যে শতকরা ৮৩% নারী শ্রমিক।
শোভন কাজের অন্যতম পূর্বশর্ত হল শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মক্ষেত্র। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস এর উদ্যোগে ‘তৈরি পোশাক শিল্পে শোভন কাজের পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছরই কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ও নানা ধরণের সহিংসতায় হতাহত হন তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর নিরাপদ কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করতে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স কাজ শুরু করে। এছাড়া বাংলাদেশ সরকার কর্মস্থল নিরাপদ করতে জাতীয় উদ্যোগ (ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ) গ্রহণ করে। গত পাঁচ বছরে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স যথাক্রমে ৯০ ও ৯৩ শতাংশ সহযোগী কারখানার সংস্কার কাজ সম্পন্ন করেছে।
ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের অধীনে মূল্যায়নকৃত তৈরি পোশাক কারখানাগুলির সংস্কার কাজ পরিচালনা করতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) এর অধীনে একটি সংস্কারকাজ সমন্বয় সেল (আরসিসি) স্থাপন করা হয়। এই কার্যক্রমের আওতায় এখন পর্যন্ত ৩৮ শতাংশ কারখানার সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এসব সংস্কার কাজের পরিপ্রেক্ষিতে কারখানাগুলো শ্রমিকদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ না হলেও পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে ঝুঁকিমুক্ত। তবে গার্মেন্টস্ এর সাব কন্ট্রাক্ট কারখানার শ্রমিকরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন। অনেক কারখানার অবকাঠামোগত পরিবর্তন হলেও ভেতরের কাজের পরিবেশের পরিবর্তন অনেকাংশে অপরিবর্তনীয়। এই খাতের ২২ শতাংশ নারী শ্রমিককে এখনও শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এই নির্যাতনের পাশাপাশি অন্যান্য সমস্যা যেমন বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব, বিষাক্ত গ্যাস প্রভৃতি প্রতিকূল পরিবেশের কারণে পোশাক শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ একটি প্রশ্নাতীত বিষয়।
২০১৮ সালে কর্মস্থলে অস্বাস্থ্যকর পানি পানের জন্য ৩৫ জন পোশাক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একজন শ্রমিক অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
বিলস এর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালে অন্যান্য বছরের তুলনায় পোশাক শিল্প খাতে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার হার ছিল অনেক কম। জাতীয়- আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহের প্রচেষ্টা এবং কারখানা মালিকদের সচেতনতার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৮ সালে বড় ধরণের কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি পোশাক শিল্প খাতে। তবুও ২০১৮ সালে তৈরি পোশাক শিল্পে দুর্ঘটনায় ৩ জন শ্রমিক নিহত ও ১৮ জন শ্রমিক আহত হন। দুর্ঘটনার পরিমাণ কমলেও ২০১৮ সালে এ খাতের শ্রমিকদের উপর সহিংসতার পরিমাণ বেড়েছে যা সংখ্যায় মোট ১১০টি, যার মধ্যে ২৬ টি নির্যাতন, ২১ টি হত্যা, ১১টি ধর্ষণ এবং ৯টি গণধর্ষণ এর মতো ঘটনা রয়েছে।
এছাড়া ২০১৮ সালে শুধু পোশাক শিল্প খাতে ১২৩ টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে এবং এতে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ২৯৮ জন শ্রমিক। শুধু মাত্র বকেয়া বেতন আদায়ের দাবিতেই ৫৪ টি শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে।
এমতাবস্থায় তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের শোভন কাজ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সমন্বিত করে মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। শ্রমিকদের শোভন জীবনমান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জাতীয় ক্ষেত্রে আলোচনার পথ প্রশস্ত করে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার মধ্য দিয়ে ‘বৈশ্বিক জবাবদিহিতামূলক সরবরাহ ব্যবস্থা কাঠামো’ গড়ে তুলতে হবে, যার মধ্য দিয়ে তৈরী হতে পারে শোভন কাজ ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মালিক, শ্রমিক, সরকার এবং সর্বোপরি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসমূহের দায়বদ্ধতা।
এদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার কার্যত উপেক্ষিতই। তবে বর্তমানে ৪৩টি খাতের শ্রমিকদের জন্য নূন্যতম মজুরি দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে সরকারের। অর্থাৎ এগুলো প্রাতিষ্ঠানিক খাত। কিন্তু বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের প্রতিনিধিত্বকারী কৃষি খাতই অপ্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে রয়ে গেছে। এর বাইরে নির্মাণ শ্রমিকদের বড় অংশ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দিনমজুর, গৃহশ্রমিক, প্রাইভেট ড্রাইভারসহ আরো অনেক খাত রয়েছে, যেগুলো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত হিসেবে পরিচিত।
ওইসব খাতের শ্রমিকরা দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হলে আইনগতভাবে ক্ষতিপূরণ চাইতেও পারবেন না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস্) এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বাইরে প্রায় ৬০টি খাত রয়ে গেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে। এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদ (বিআইডিএস) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের শ্রম শক্তির ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানক খাতের।
ওই গবেষণায় বলা হয়, আত্মকর্মসংস্থান এবং ব্যক্তিনির্ভর ব্যবসার কাজে শ্রম দিচ্ছে বেশির ভাগ শ্রমিক। কৃষি খাত ছাড়াও নির্মাণ ও সংশ্লিষ্ট কাজ, চাতাল, সেলাই কাজ, ওয়েল্ডিং, তাঁত, চিংড়ি-মৎস্য চাষ ও প্রক্রিয়াকরণ, প্রিন্টিং, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, শিক্ষা খাত, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কর্ম, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান, ইটভাটা, গৃহস্থালি কর্ম, কুলি, দিনমজুরসহ ছোট ম্যানুফ্যাকচারিং খাত হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপের তথ্য মতে, দেশে মোট শ্রমশক্তির সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ। এর মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আছে প্রায় ৫ কোটি ৬৫ লক্ষ। দুঃখজনক হলেও এটাই নিষ্ঠুর সত্য, এই বিশাল শ্রমিক গোষ্ঠীর নেই কোনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি! বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত।
দেশে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ৩৯ শতাংশ নিয়োজিত আছে কৃষি খাতে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সর্বোপরি এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা বিধানে কৃষি খাত যে অনন্যসাধারণ অবদান রেখে চলেছে তা নজিরবিহীন। অথচ এখানে কর্মরত শ্রমশক্তির ৯৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক!
কৃষির পরেই কর্মসংস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে সেবা খাত। অনধিক ২ কোটি ৩৭ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছে এই খাতে। তারপরের স্থান শিল্প খাতের যেখানে কাজ করে প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ শ্রমিক। ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭’ এর তথ্য অনুযায়ী সেবা খাতে কর্মরত শ্রমশক্তির প্রায় ৭২ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক অন্যদিকে শিল্প খাতে এই সংখ্যা আরও উদ্বেগজনক প্রায় ৯০ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রতি সরকারের অনতিবিলম্বে সুদৃষ্টি দিতে হবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসতে হবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে। সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি আইনি কাঠামো যার মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতি মিলবে এই খাতের এবং একই সঙ্গে এই খাতে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তির ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে যা পালন করবে রক্ষাকবচের ভ‚মিকা।
দেশে নিশ্চিত হয়নি শোভন কর্মপরিবেশ, অধিকার বঞ্চিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা
পূর্ববর্তী পোস্ট