নিজস্ব প্রতিবেদক: ভাত রুটি না খেয়ে একবেলা থাকা যায় কিন্তু পানি না খেলে এক মূহুর্ত কাটে না জীবন। বৈশাখের তীব্র এই তাপদাহে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে দুই কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে কলশি নিয়ে দুর্গাবাটি সাইক্লোন সেল্টার থেকে বিশুদ্ব খাবার পানি সংগ্রহ করতে এসে কথা গুলো বলছিলেন সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের তাপসি মন্ডল। তার পাশে দাঁড়িয়ে পানি নিতে আসা এইক ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পঞ্চাশউর্দ্ধ কতবানু বিবি জানালেন ৫ মাস ধরে আকাশে কোন বৃষ্টি নেই। খাবার পানির অধিকাংশ পুকুর গুলো শুকিয়েগেছে। রোজার মধ্যে বাধ্য হয়ে ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কিছু দিন আগেও হুলা গ্রামের মহাসিন সাহেবের শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের কর্দমাক্ত দুর্গন্ধময় পানি সংগ্রহ করে বাধ্য হয়ে খেতে হয়েছে। আরডব্লিউএইচ, পিএসএফ সমূহ যথযথ ভাবে কাজ না করায় সে গুলোও নষ্ট হয়েগেছে। স্থানীয় সেসরকারি সংস্থা লির্ডাস এর সহায়তায় দুর্গাবাটি সাইক্লোন সেল্টারে পানি সংগ্রহ করতে আসা তাপসি মন্ডল,কতবানুর মত পায়ে হেটে আরও ৩ থেকে ৪ গ্রামের শত শত মানুষ এসেছেন সুপেয় পানি নিতে। সবার কাকে কলস। পানি নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের র্দীঘ অপেক্ষা। এ চিত্র এখন বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিন-পশ্চিমের জনপদ গোটা কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার উপকূল জুড়ে। দেশের সর্ব দক্ষিন এ জনপদের প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ তীব্র বিশুদ্ধ খাবর পানি সংকটে রয়েছে।
উপকূল জুড়ে মাঠের পর মাঠ এখন শুধু ধু-ধু বালু চর। খাল-বিলে পানি নেই। ২/৩ মাসের মধ্যে আকাশের বৃষ্টি না হওয়ায় পানির অধিকাংশ উৎসগুলো শুকিয়ে গেছে। নলকুপে পানি ঠিকমত উঠছেনা। ভূগর্ভস্থ পানির স্থর নিচে নেমে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোর চার দিকে পানি আর পানি কিন্তু সর্বত্রই লবন পানি। উপকূলের কিছু কিছু এলাকার দুই একটি গভীর নলকুপে দীর্ঘ সময় ধরে হ্যান্ডেল চেপে চেপে যতসামান্য পানি উঠলেও তাও আবার নোনা পানি। পানের উপযোগী এক ফোঁটা পানির জন্য রীতিমত হাহাকার চলছে।
দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় এবং পানির স্থর নেমে যাওয়ায় জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৬৩৮টি গভীর ৩৫৮টি অগভীর নলকুপ ছাড়াও ৩৯৭টি ভিএইচএসটি ৪৮৩টি এস এসটি ১০৯৮টি আরডব্লিউএইচ এবং ৫৬৬টি পিএসএফ এর মাধ্যমে স্থানীয়দেও আর এখন পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী, নীলডুমুর, গাবুরা, পদ্মপুকুর, ভেটখালি, কৈইখালি, নলখাগড়া, তালবাড়িয়া, কুটিকাটা, কাঁঠালবাড়িয়া, কাছিহারানি, কাশিপুর, হেঞ্চি, আটুরিয়া, ছোটকুপোট আশাশুনির প্রতাপনগর, শ্রীউলা, বলাবাড়ীয়া, শ্রীউলা এবং কালিগঞ্জ উপজেলার ভাড়াশিমলা ও মথুরেশপুর, হাড়ৎদাহ সহ আশে পাশের অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি তীব্র খাবার পানি সংকট চলছে। এলাকাবাসীর ভাস্যমতে কালিগঞ্জ, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ তীব্র বিশুদ্ধ খাবর পানি সংকটে রয়েছে। একই অবস্থা খুলনার কয়রা,পাইকগাছা অঞ্চলে। সেখানেও সুপেয় পানির জন্য হাহাকার চলছে। টিউওয়ালে খাবার পানি ঠিকমত উঠছে না।
এদিকে গত ২১ এপ্রিল থেকে সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলায় ভ্রাম্যমান মোবাইল ওয়াটার টিটমেন্ট প্লান্টের আওতায় ৬ হাজার লিটার বিশুদ্ধ সুপেয় পানি উপকূলবাসীকে সরবরাহ করে যাচ্ছে। সেটি অবশ্য প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল বলে দাবি এলাকাবাসীর।
উপকূলবাসীর খাবার পানির সমস্যা দীর্ঘ দিনের। সাতক্ষীরা জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সুত্র মতে ২০১৮ সালে খাবার পানি নিয়ে উপকূলবাসীর সমস্যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় পুকুর, দীঘি,জলাশয়,পুনঃখনন প্রকল্প গ্রহন করে। এক একটি পুকুরের ব্যয় ধরা হয় ১৯ লাখ থেকে ৬৮ লাখ টাকা পর্যন্ত। যার অংশ হিসাবে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জেলা পরিষদের ৪৭টি পুকুর খনন করে পিএসএফ দেওয়া হয় খবার পানির জন্য। পুকুর গুলির পূর্বকার পাড় হতে ১৮ ফুট গভীর হওয়ার কথা ছিল। এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে খননকৃত প্রতিটি পুকুর পাড়ের ওপর ২/৩ ফুট মাটি ফেলে গভীরতা অক্ষুন্ন রাখে। ফলে খনন কাজে শুভংকরের ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ও সংশিলিষ্ট অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। যার কারনে পুকুরের গভীরতা না থাকায় এই সময়ে পুকুরে পানি না থাকার বিষয়টি নিয়ে খনন কাজের অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন কাঠালবাড়ীয়া গ্রামের অনিল মন্ডল, সুধংশু মন্ডল ও আব্দুর রশিদসহ আরো অনেকেই।
এ অবস্থায় সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোঃ আরশাদ আলী জানান, জেলায় গভীর, অগভীর নলকুপ, ভিএসএসটি, এসএসটি, পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হারবেসটিং সহ মোট ৪৩৯৮১টি সুপেয় পানির উৎস রয়েছে। এর মধ্যে আশাশুনিতে ৬৫১১টি এবং শ্যামনগরে রয়েছে ৫৪৫১টি। বিশেষকরে উপকুল অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ্য পানির স্তর ২৫ থেকে ৩০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকুপ গুলোতে পানি উঠছে না।রঅকেজো হয়ে পড়েছে। অধিকাংশ আরডব্লিউএইচ, পিএসএফ নষ্ট হয়েগেছে। ফলে দেশের দক্ষিন এই জনপদে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। তবে এই মূর্হুত বৃষ্টি হলে কিছুটা সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব।