# প্রশাসন অভিযানে পালালেও ফের দখল, লুটে নামে সন্ত্রাসীরা।
# কথিত ভূমিহীনদের নামে গড়ে তুলেছে অপরাধের অভয়াশ্রম।
# মাদক ও অস্ত্রের নিরাপদ ঘাটিতে পরিণত করেছে অপরাধীরা।
# খলিশাখালিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দাগী অপরাধীদের আঁখড়া।
# অবৈধ দখল নিয়ে জনপদের নাম দেওয়া হয় শেখ মুজিব নগর।
# কয়েক অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন জমির মালিক ও লিজ গ্রহনকারীরা।
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেবহাটা উপজেলার খলিশাখালির বিস্তৃর্ণ মৎস্যঘের দখল, লুটপাট থামছে না। বিভিন্ন এলাকার দাগী সন্ত্রাসী, হত্যা, ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক সহ একাধিক মামলার আসামিদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি বাহিনী। স্থানটি প্রত্যান্ত এলাকায় হওয়ায় সহজে যে কোন অপরাধ সংঘটিত করতে পারেন এসব সন্ত্রাসীরা। এতে বছরের পর বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ছেন ওই এলাকার মাছ চাষিরা। বিগত ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর রাতের আধারে বোমা ফাটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে ১৩’শ বিঘা সম্পত্তি দখল করে নেয় ভূমিহীনরা নামধারী ভূমিদস্যুরা। তারা এসব জমি সরকারি সম্পত্তি হিসাবে দাবি করলেও তা ব্যক্তি মালিকানা রেকর্ডীয়।
জানা গেছে, দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া মৌজার ৩০টি খন্ডে বিভক্ত খলিশাখালী নামক ব্যাক্তি মালিকানাধীন ৪৩৯.২০ একর (১৩২০ বিঘা) সম্পত্তিতে বিস্তৃর্ণ মৎস্যঘের রয়েছে। ১৯৪৭ সালের দিকে জমির সিএস মালিক ইশ্বরচন্দ্র ঘোষের ছেলে চন্ডীচরণ ঘোষের ৪৩৯.২০ একর (এক হাজার তিনশত বিশ বিঘা) জমির মালিক হন দেবহাটার শিমুলিয়ার আব্দুল মালেক ওরফে মালেক কাজী। পরবর্তীতে তাদের উত্তরসূরি ও ক্রয়মূলে ২’শ ব্যক্তি খলিশাখালির ওই বিস্তীর্ণ সম্পত্তির মালিক হয়ে সেখানে চিংড়িঘের করে আসছিল।
গত ২০২১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসীরা চাষাবাদকৃত জমিতে অবৈধভাবে দখল প্রায় ৪ কোটি টাকার মাছ লুটপাট করে নিয়েছে এবং ঘেরে বাসা বাড়ি ভাংচুর করে আরো ৩৬ লক্ষ টাকা ক্ষতি সাধন করে বলে তৎকালীন এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে মালিক পক্ষ। পরে ১২ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা কোর্টে মামলা দায়ের করে মালিকপক্ষ। রেকর্ডীয় জমি ১৮১২ নং সিএস খতিয়ানে ১১১৭৫ নং দাগ সহ ২৭টি দাগে উপরে উল্লেখিত ৪৩৯.২০ একর জমির সিএস মালিক চন্ডিচরণ ঘোষ। যা বিভিন্ন কোবলা দলিল, পাট্টা দলিল ও কোর্টের রায় অনুযায়ী নিলাম খরিদ মোতাবেক এসএ ২৯৬২ থেকে ২৯৮০ খতিয়ানে রেকর্ড প্রকাশের পূর্বে কলিকাতা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে ০৪/০৩/৫৩ তারিখের ৬৯৪ নং বিনিময় দলিল মূলে দেবহাটা থানার শিমুলিয়া গ্রামের তেজেন্দ্র নাথ চৌধূরীর পুত্র সুরেন্দ্রনাথ চৌধূরী এর সাথে বিনিময় করেন। এসএ রেকর্ড পরবর্তী উক্ত বিনিময় দলিলের গ্রহীতা কাজী আব্দুল মালেক এর ওয়ারেশ গণ সহ ক্রমিক হস্থান্তর সূত্রে অপারপর মালিকগণ বর্তমান বিআরএস জরিপে রেকর্ড প্রাপ্ত হন এবং তৎপরবর্তী প্রিন্ট পর্চা সহ প্রায় ৩০০ মালিক এর নামে ২০০টি পর্চায় উক্ত সম্পত্তি গেজেট প্রকাশিত হয় এবং মালিকগণের হালসন পর্যন্ত খাজনা পরিশাধ করেছেন। এছাড়া ১৯৫৩ সাল থেকে মালিকপক্ষ দীর্ঘ ৭০ বৎসর নিরবিছিন্নভাবে ভোগ দখল করে আসছেন। সেহেতু অন্য কোন পক্ষের উক্ত সম্পত্তিতে যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও আওয়ামী লীগ ও কিছু বিপদগামী ব্যক্তিদের উস্কানিতে ওই জমি দখলে নিয়ে ২০২১ সালে সেখানের নাম দেওয়া হয় “শেখ মুজিব নগর” খলিশাখালী ভূমিহীন আবাসন কেন্দ্র। কয়েক দিনের মধ্যে পুরো মৎস্যঘের থেকে প্রায় শত কোটি টাকার মাছ ও সম্পত্তি লুট করে সন্ত্রাসীরা। এই টাকা দিয়ে সেখানে গড়ে তোলা হয় অপরাধের অভয়াশ্রম। মাদক, অস্ত্রের নিরাপদ ঘাটি হিসাবে জায়গাটি ব্যবহার করতেন তারা।
জানা গেছে, ভূমিহীন নামধারী এসব সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের উচ্ছেদাভিযান ঠেকাতে তাদের কাছে পর্যাপ্ত দেশি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র ও হাতবোমা রাখেন। আস্তানা গাড়া কুখ্যাত আকরাম ডাকাতের নেতৃত্বাধীন আকরাম বাহিনী, গফুর ডাকাত, কালু ডাকাত, তার ছেলে সিদ্দিক গাজী, আকরাম ঢালী, শরিফুল সহ জেলার বহু দাগী অপরাধীরা দিনের বেলা এসব অস্ত্রধারী বাহিনী খলিশাখালির আশপাশে আত্মগোপনে থাকলেও, সন্ধ্যার পর থেকে গোটা খলিশাখালি এলাকায় দাঁপিয়ে বেড়ায়। তাদের হাতে থাকে দেশি বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র।
খলিশাখালির এসব ভূমিদস্যদের মদদদাতা রয়েছে কয়েকজন। তারা উপরে বসে কলকাঠি নাড়েন, নির্দেশনা দেন, আইনি জটিলতা বা অন্য কোন ঝামেলা সৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় মোটা অংকের টাকা নিয়ে দফারফা করেন।
এদিকে, দেড় বছর পর গত ২০২২ সালের ১৫ নভেম্বর দেবহাটার খলিশাখালি ভূমিদস্যুদের কবল থেকে দখলমুক্ত হয়। এরপর ওই জমির মালিক ও লিজ গ্রহণকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে মাছ চাষ করে আসলেও কিছু দিন যেতে না যেতে আবারো ডাকাতি ও লুটপাতের প্রস্তুতি নিতে থাকে সন্ত্রাসীরা। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন হওয়ায় পর আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে কেন্দ্র করে পুনরায় মৎস্যঘেরে ডাকাতি ও লুটপাট করে ভূমি দস্যুরা। পরবর্তীতে (১ নভেম্বর) খলিশাখালি এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এসময় জনতার গনপিটুনিতে কামরুল ইসলাম (৪০) নামের এক ডাকাত সদস্য নিহত হন। পরে ওই স্থান থেকে আরো ৬ জনকে গ্রেফতার করে। সেই সাথে অস্ত্র, বোমা উদ্ধার হয়। কিন্তু বোমা, বোমা তৈরি সামগ্রী, দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হলেও আগ্নেয়অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এছাড়া মুলহোতারা গ্রেফতার না হওয়ায় সেখানের আতঙ্ক কাটেনি। এমনকি সেনাবাহিনী অভিযান করে ফেরার পর সেখানে আবারো মহড়া দিতে দিচ্ছে সন্ত্রাসী আরিফ পাড়, রিপন, আল-আমিন, রাজু সহ আরো অনেকে।
জমির মালিক কাজী গোলাম ওয়ারেশ, আনসার আলী, আব্দুল মাজেদ, এবাদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, আব্দুল খালেক, রেজাউল ইসলাম সহ আরো অনেকে বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষের বৈধ মালিকানাধীন খলিশাখালির ১৩ শ ২০ বিঘা এলাকায় সন্ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম করে বিভিন্ন সময়। প্রশাসন তাদের উচ্ছেদ করার পরও বিভিন্ন সময় অস্ত্র ঠেকিয়ে আমাদের ঘেরের মাছ লুট, দখল করে আসছে। আমরা বৈধ কাগজের মালিক হলেও বিভিন্ন সময় হত্যা, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, কুখ্যাত ও পলাতক সন্ত্রাসীদের দ্বারা আমরা বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। আমরা এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
দেবহাটা থানার ওসি নুর মোহাম্মাদ বলেন, সেনা বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে ৬ জনকে আটকের পর তাদেরকে শনিবার জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমান খলিশাখালিতে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছি।