
জাকাতের আর্থ–সামাজিক গুরুত্ব:
জাকাত গরিবের হক হিসেবে আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। জাকাত দেওয়া ফরজ। জাকাত না দিলে বা তা অস্বীকার করলে দুনিয়া ও আখিরাতে ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে। আর জাকাত দিলে মানুষ শুধু তার সম্পদের পবিত্রতা ও বৃদ্ধিই অর্জন করবে না, এতে তার পরকালীন মুক্তির পথও সুগম হবে। এ ছাড়া জাকাত সামাজিক জীবন ও জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জাকাত সম্পদকে পবিত্র করে। জাকাত ধনীদের পরিশুদ্ধ করে। জাকাত দারিদ্র্য দূর করে। জাকাত উৎপাদন বৃদ্ধি করে। জাকাত গরিব, দুঃখী ও অভাবী মানুষের মধ্যে বণ্টিত হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে এসব লোকের চাহিদা বাড়ে। চাহিদা পূরণের জন্য বৃদ্ধি পায় উৎপাদন ও জোগান। এতে চাহিদা, উৎপাদন ও মুনাফাও বেড়ে যায়। ফলে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হয়। বেড়ে যায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। জাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে। ফলে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূরীভূত হয়। জাকাত ধনীদের সম্পদকে গরিবদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। ফলে সম্পদ শুধু ধনীদের হাতেই আটকে থাকে না। জাকাত সমাজে শান্তি আনয়ন করে। জাকাতের ওপর অর্থনীতির যে ভিত তৈরি হয় তাতে ধনী-গরিবের বৈষম্য কমে যায়। সমাজের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতে সম্পদ বণ্টিত হওয়ার ফলে সমাজে থাকে না কোনো বিরোধ। এতে সমাজে আসে শান্তি ও নিরাপত্তা। একটি স্থিতিশীল সমাজ ও টেকসই অর্থনীতি পরিগঠনে তাই জাকাতের ভূমিকা অনন্য।
ফিতরার পরিচয়:
ঈদুল ফিতরের দিন সকালবেলা সাহেবে নিসাবের তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। যিনি সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা বা সমমূল্যের সম্পদের মালিক থাকবেন, তিনিই সাহেবে নিসাব।
ফিতরা নির্ধারিত খাদ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও আদায় করা যায়। অথবা অন্য কোনো বস্তু কিনেও ফিতরা দেওয়া যায়। বেশির ভাগ সাহাবায়ে কেরাম খেজুর দিয়ে ফিতরা আদায় করতেন। ইবনে খুদামা (রা.) আবু মিজলাজের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-কে বলেন, আল্লাহ তাআলা যখন প্রাচুর্য দিয়েছেন আর গম যেহেতু খেজুরের চেয়ে উত্তম, তবু আপনি খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করছেন কেন? জবাবে তিনি বলেছেন, সাহাবিরা যে পথে চলেছেন, আমিও সেই পথে চলতে পছন্দ করি। তখন খেজুর অপেক্ষা গম ও আটার দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও সাহাবিরা খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় পছন্দ করতেন।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.)-এর জামানায় আমরা ফিতরা দিতাম এক সা খাদ্যবস্তু। এক সা বলতে প্রায় সাড়ে তিন কেজি খাদ্যবস্তু বোঝায়। তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল যব বা কিশমিশ বা মোনাক্কা, পনির ও খেজুর। মহানবী (সা.)-এর জামানায় মদিনায় গমের প্রচলন কম ছিল। পরবর্তী সময়ে গমের প্রচলন হলে হজরত মুয়াবিয়া ও উমর (রা.)-এর নির্দেশে গম দ্বারা ফিতরা আদায়ের বিধান চালু করা হয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সদকাতুল ফিতর যেকোনো খাদ্যবস্তু এক সা বলে মত দিয়েছেন। ইমাম মালিক (রহ.), ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহ.) সদকাতুল ফিতর যেকোনো খাদ্যবস্তু এক সা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁরা অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করাকে উত্তম বলে মত দিয়েছেন। অন্য ইমামরাও বস্তুগুলোর মধ্যে সর্বোত্কৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতরা আদায় করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘যা দ্বারা আদায় করলে গরিবের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম ফিতরা।’
ফকিহদের মতে, যেখানে যা প্রধান খাদ্য, ফিতরা তার দ্বারা আদায় করা শ্রেয়। বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে মুজতাহিদ ইমামরা বলেছেন এভাবে, যেসব খাদ্যবস্তু সহজে সংরক্ষণযোগ্য, বিনিময়যোগ্য এবং যার বাজারমূল্য স্থিতিশীল, সেসব খাদ্যবস্তু দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়।
এখানে উল্লেখ্য, উল্লিখিত খাদ্যবস্তু বিভিন্ন দামের রয়েছে। তাই উত্তম হলো সেই খাদ্যবস্তু দ্বারা ফিতরা আদায় করা উচিত, যেটি সর্বোচ্চ মূল্যের। ধনীদের সর্বোচ্চ এবং সাধারণ লোকদের মাঝামাঝি মূল্যের খাদ্যবস্তু দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা শ্রেয়। সূত্র: কালেরকন্ঠ
লেখক : সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড