
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরা সদর উপজেলা ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ওয়ারিয়া গ্রামে ২০২০ সালের ১৩ই জুলাই ছয়জন নারী ও একজন শিশুকে পুলিশ ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে ঘরের দরজায় মেরে দেওয়া তালা হাইকোর্টের নির্দেশে খুলে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ২১ই সেপ্টেম্বর দুপুর দুইটার দিকে পুলিশ সুপারের নির্দেশে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হুসেন এ তালা খুলে আবুল বাসারের হাতে তুলে দেন।
ওয়ারিয়া গ্রামের নাদের আলী গাজীর ছেলে আবুল বাসার জানান, তার মা জামেলা খাতুন ও প্রতিবন্ধি নাবালক ভাই ইশারতের অভিভাবক হিসেবে ছয় শতক করে মোট ১২ শতক জমি বিক্রি করেন একই গ্রামের বারী মোল্লার কাছে। এ ছাড়াও প্রতিবন্ধি ইশারতের ওয়ারেশ স‚ত্রে প্রাপ্ত পৈতৃক সাড়ে ১০ শতক জমি যাহা ভাই মোশারফের কাছে ২০০২ সালে বিক্রি করলেও ওই জমি ২০০৪ সালে স্ত্রী জাহানারার নামে কেনা হয়েছে মর্মে দাবি করে আসছিল বারী মোল্লা। পরবর্তীতে বারী মোল্লাকে ১৯ শতক জমি দিতে তারা রাজি হলেও বারী মোল্লা মানতে চাননি।
আবুল বাসার আরো জানান, গত বছরের ১৩ জুলাই সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আব্দুল বারী মোল্লা ও তার ছেলে আবুল বাসারসহ বিভিন্ন এলাকার থেকে ভাড়া করা ৭০/৭৫ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাদের বাড়িতে হামলা চালায়। তারা ঘরের মধ্যে ঢুকে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। বাধা দেওয়ায় তাকেসহ মা জামেলা, আকবর আলী, আশরাফের ছেলে শরিফুল ইসলাম, আশরমের ছেলে আরিফুল, ইসমাইলের স্ত্রী মাজেদা ও আবুল হোসেনের স্ত্রী হালিমাকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করা হয়। স্থানীয়রা তাদেরকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে। পুলিশের সহায়তায় বারী মোল্লা তাদের বাড়ি দখলে নিতে পারে এমন খবর পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আকবর আলী, আরিফুল, মাজেদা ও হালিমা বাড়িতে চলে আসেন বাড়িতে। দুপুরে তিনি মামলা দিতে গেলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান তাকে ফিরিয়ে দেন। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সাবেক ইউপি সদস্য রজব আলীসহ সাতক্ষীরা সদর সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মীর্জা সালাহউদ্দিন, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান, পুলিশ পরিদর্শক আবুল কালাম ও উপপরিদর্শক হাসানুজ্জামানের নেতৃত্বে কয়েকজন মহিলা পুলিশসহ ৩৫/৪০ জন পুলিশ তাদের বাড়িতে আসে। মহিলা পুলিশ তাদের বাড়ির মধ্যে অবস্থানরত লায়লা খাতুন, ফতেমা খাতুন, হালিমা খাতুন, আশুরা, শিমু, মুন্নি ও শিশু সুমাইয়াকে টেনে হিচড়ে রাস্তায় নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলে। এর আগে ঘর থেকে বের করার পর কয়েকজন পুরুষ পুলিশ সদস্য নারী ও শিশুদের লাথি মেরে উঠানে ফেলে দেয়। বাড়ি লোকজন শ‚ন্য করার পর পুলিশ পরিদর্শক আবুল কালাম ওই ঘরের দরজায় বারী মোল্লার দেওয়া তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে আসেন। পরে এক শিশু ও ছয় নারীকে ১৫১ ধারায় নিরাপত্তা দেওয়ার নামে থানা হাজতে রেখে ১৪ জুলাই সকালে ওই ছয় নারীকে বারী মাওলানার দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ১৩ জুলাই বিকেলে পুলিশ ঘরের মধ্যে ঢুকে নারী ও শিশুদের টেনে হিচড়ে বের করে আনার চেষ্টার সময় সাংবাদিকদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়।
একপর্যায়ে তিনি (আবুল বাসার) গত বছরের ২০ অক্টোবর সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কাছে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য ঘরে চাবি চেয়ে আবেদন করেন। সাতক্ষীরার নবাগত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন এর তদন্ত করেন। একপার্যায়ে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি তিনি (আবুল বাসার) হাইকোর্টে ২৭২৮/২১ নং রিট পিটিশন দাখিল করেন। গত ১৬ মার্চ তার দায়েরকৃত রিট পিটিশন শুনানী শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ কামরুজ্জামান ও বিচারপতি মাহমুদ হাসান তালুকদারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, সদর সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার মীর্জা সালাহউদ্দিন(বর্তমানে বদলী) ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামানকে ডাকযোগে আদেশ প্রাপ্তির পরবর্তী তিন কার্য দিবসের মধ্যে তালা খুলে দেওয়ার আদেশ দেন। এ আদেশ পালন করেনি পুলিশ। উপরন্তু গত ২৫ আগষ্ট বিকেলে সদর থানা থেকে কালীগঞ্জ থানায় বদলী হওয়া উপপরিদর্শক হাসানুজ্জামান তাদের বাড়িতে এসে তালা খুলে দিয়ে বারী মাওলানাকে ঘরে তুলে দেন। পরদিন বিকেলে উপপরিদর্শক হাসানুজ্জামান এসে বারী মাওলানাকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে চলে যান। পুলিশ তালা খুলে না দেওয়ার বিষয়টি ২৮ আগষ্ট মহামান্য হাইকোর্টে আবারো উপস্থাপন করা হয়। আদালত ওই নতুন আদেশ প্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তালা খুলে দেওয়া ও ৫ সেপ্টেম্বর এটর্ণি জেনারেলের মাধ্যমে ১৬ মার্চের আদেশ কেন পালন করা হয়নি তার ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন। পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানের দেওয়া জবাব ৬ সেপ্টেম্বর উপস্থাপন করা হলে আদালতের কাছে তা যথাযথ মনে হয়নি। ৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মোঃ খসরুজ্জামান ও বিচারপতি মোঃ মাহমুদ হাসান তালুকদারের মন্বয়ে গঠিত বেঞ্জ আদেশ প্রাপ্তির ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবুল বাসারের ঘরের তালা খুলে দিয়ে প‚র্বের নির্দেশ কেন পালন করা হয়নি তা ২৩ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে জবাব দেওয়ার জন্য সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেন।
এঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার দুপুর দুইটার সময় সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হুসেন ও পুলিশ পরিদর্শক বাবুল আক্তারসহ কয়েকজন পুলিশ ওয়ারিয়া গ্রামে যেয়ে সেই ঘরের তালা খুলে দেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হুসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশে তালা খুলে দেওয়া হয়েছে।’