হাবিবুর রহমান :
আমরা যখন বাকুতে কপ২৯ নিয়ে কথা তুললাম, তখন বিশ্বনেতারা একটি নতুন জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করতে চলেছেন। এতে দরিদ্র দেশগুলোর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে এবং জলবায়ু সংকটের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। তাদের আলোচনার সময় আবহাওয়া পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমানভাবে তীব্র হচ্ছিল। কেবল এই বছরেই আমরা উত্তর আফ্রিকা, মেক্সিকো, ভারত ও সৌদি আরবজুড়ে মারাত্মক তাপপ্রবাহ দেখেছি। দক্ষিণ আফ্রিকাজুড়ে একটি ঐতিহাসিক খরা; ব্রাজিলের প্যান্টানাল জলাভূমিতে বিপর্যয়কর দাবানল; ক্যারিবিয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ভঙ্গকারী হারিকেন এবং আরও অনেক কিছু। জলবায়ু পরিস্থিতি একদিকে কোনো সীমানা মানে না, একইভাবে কাউকে ছাড়ও দেয় না।
এসব ঘটনা জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষা করার জন্য বিশ্বনেতাদের এবং আমাদের সবার জন্য প্রয়োজনীয়তার স্পষ্ট অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য, বিশেষ করে আফ্রিকায় জলবায়ুর প্রভাবজনিত খরচ বিস্ময়কর। আফ্রিকার দেশগুলো জলবায়ুর চরম রূপ নেওয়ার কারণে জিডিপির ৫ শতাংশ পর্যন্ত হারাচ্ছে। এ অঞ্চলের অনেক দেশ এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে তাদের জাতীয় বাজেটের ৯ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ দিচ্ছে। ওয়ার্ল্ড মেটোরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, সাহারা অঞ্চলে শুধু আফ্রিকার দক্ষিণে অকল্পনীয় জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয়ের মুখোমুখি সম্প্রদায়গুলোকে রক্ষার জন্য আগামী দশকে বার্ষিক ৩০ বিলিয়ন থেকে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এড়িয়ে গিয়ে আমরা দারিদ্র্য হ্রাস, ক্ষুধা দূর এবং একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিস্থাপক বিশ্ব সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারব না।
এ পরিমাণ অর্থের বরাদ্দ আমাদের জন্য বোঝা। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের তথ্যমতে, ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রায় ৮৯.৬ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা হয়েছিল। তবুও বৈশ্বিক জলবায়ু-সংক্রান্ত অর্থায়নে বিপর্যয় কমিয়ে আনতে বিভিন্ন মাত্রায় মনোযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু সংকটের প্রভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ ও টিকে থাকতে সক্ষম করে গড়ে তোলার জন্য দেশগুলোকে সমর্থন করার পরিবর্তে নির্গমন হ্রাসে অর্থায়নের প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যয় করা হয়। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে আসে; বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যেগুলো ইতোমধ্যে ঋণের যন্ত্রণায় পঙ্গু।
অর্থায়নের ক্ষেত্রে সংকট কমিয়ে আনা ও পরিস্থিতি খাপ খাওয়ানোর ব্যয়ের উভয় ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ দিয়ে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে আমি বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানাই। সফলতা পেতে পরিবর্তন আনার মানে চ্যালেঞ্জের পরিমাণের সঙ্গে মোকাবিলা করতে জনসাধারণের জন্য তহবিল বাড়িয়ে দেওয়া। এটি অবশ্যই কপ২৯-এ আলোচিত নতুন যৌথ পরিমাপকৃত লক্ষ্যের (এনসিকিউজি) একটি মূল উপাদান হতে হবে, যেখানে সমান অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে মোকাবিলার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পৃথক বলে স্বীকৃতি পাবে। মোকাবিলা করতে বরাদ্দকৃত অর্থ বাড়ালে ইতোমধ্যে জলবায়ু সংকটের বিধ্বংসী প্রভাবের সম্মুখীন হওয়া সম্প্রদায়গুলো রক্ষা করার জন্য সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত হবে।
কপ২৯-এ মোকাবিলা অর্থায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া অবশ্যই সাহসী ও রূপান্তরমূলক হতে হবে। ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের বিপদ অনেক বেশি। বিপর্যয় মোকাবিলায় কপ২৯ প্রেসিডেন্সির মন্ত্রী নিয়োগ (আয়ারল্যান্ড ও কোস্টারিকা থেকে) এনসিকিউজি আলোচনার মধ্যে মোকাবিলাকে গুরুত্ব দেওয়ার একটি ইতিবাচক সংকেত, যিনি অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত পরামর্শ ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন।
কপ২৯-এ নেতাদের অবশ্যই পাবলিক অ্যাডাপ্টেশন ফাইন্যান্স বাড়ানোর জন্য উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এ উদ্যোগ কমিয়ে আনা ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে আলাদা হিসেবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এসব অঙ্গীকার অবশ্যই উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত হবে। এখানে সবচেয়ে দুর্বলদের জন্য আরও ভালো অবস্থা নিশ্চিত করতে সহজ আবেদন প্রক্রিয়া থাকবে। শুধু এটি করার মাধ্যমে আমরা মানিয়ে নেওয়ার ব্যবধানকে সংকুচিত করা এবং অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি যাওয়ার আশা করতে পারি। এটি ২০১৫-এর প্যারিস কাঠামোর অংশ, যার লক্ষ্য জলবায়ু ভাঙনের ঝুঁকি হ্রাস।
কৃষি অভিযোজন বিশেষ করে জলবায়ু সংকটের কারণে উদ্ভূত ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এবং বর্তমান নেতৃত্বের ভূমিকায় এটি আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল। কপ২৯-এ আমি বিশ্বনেতাদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে যথেষ্ট সমর্থনের প্রতিশ্রুতির জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। জলবায়ু-সহনশীল ফসল, টেকসই চাষাবাদ অনুশীলন এবং কার্যকর পানি ও মাটি ব্যবস্থাপনার কৌশল বিকাশের জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ অপরিহার্য। কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সহায়তা শুধু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে এবং স্থিতিস্থাপকতা বাড়াবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীল ও নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখবে।
কপ২৯ জলবায়ু নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগের সুযোগ উন্মোচনের প্রস্তাব হাজির করে। এখন বিশ্বনেতাদের প্রকৃত বিশ্বনেতৃত্ব দেখানোর সময়। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উত্তীর্ণ হতে পারব?
বান কি মুন: জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব এবং সেন্টার ফর গ্লোবাল সিটিজেনসের সহসভাপতি; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম