
খোলপেটুয়ার পানি আছড়ে পড়ছে ওয়াপদার বেঁড়িবাঁধে। খসে পড়ছে মাটি । প্রশস্ত বেঁড়িবাঁধের মাটি খসে কোথাও ৩ ফুট,কোথাও ৪ ফুটে দাড়িয়েছে। দূর্বার গতিতে ছুটে চলেছে ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল। কোথাও ইটের সলিং কোথাও আবার মাটির পথ। মনে হয় এই বুঝি মোটর সাইকেল স্লিপ করলো। আরেক মোটর সাইকেলে ছিলো সহকর্মী সাংবাদিক বাংলাভিশনের সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান আসাদ। ভরদুপুরে ডুমুরিয়া খেয়াঘাটে নৌকা থেকেই নেমেই,সুন্দরবন সংলগ্ন জনপদ গাবুরা দ্বীপের অজানা গন্তব্যে ছুটে চলেছি খবরের সন্ধানে। একমাত্র বাহন ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল। মোটর সাইকেলে বসেই চোখে পড়লো ডুমুরিয়া বাজারের গোলপাতার ছাউনির ছোট ছোট দোকানঘর গুলো মাটির সাথে মিশে রয়েছে। ওয়াপদার বেঁড়িবাঁধের দ’ুপাশেই মানুষের বসতি। অধিকাংশ ঘরের ছাউনি টিন, গোলপাতা ও টালি দিয়ে নির্মিত। হুঁ হুঁ করে ছুটে চলেছে মোটর সাইকেল। চোখে পড়লো গাছের ডাল ভেঙ্গে বসত ঘরের চালে পড়েছে, কোথাও আবার গোয়াল ঘর ও রান্নাঘরের উপর। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে গাবুরা দ্বীপ গ্রাম। সে জন্যই খবরের সন্ধানে ছুটে যাওয়া। কিন্তু তেমন দৃশ্য চোখে না পড়ায় সহকর্মী আসাদের সাথে শুরু মৃদু তর্ক-বিতর্ক। সাতক্ষীরা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে দূর্গম গাবুরা দ্বীপে আসার পথেই কালিগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলার পাকা রাস্তার দ’ুধারেই অসংখ্য গাছ ভেঙে বা উপড়ে পড়তে দেখা গেলো। যদিও প্রশাসন ও স্থানীয় উদ্যোগে গাছ সরিয়ে রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচলের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। আবার কেউ কেউ রাস্তার উপর পড়ে থাকা সরকারী গাছ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালী গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো গাছ পড়েছে বসত বাড়ির উপরে। গাড়ি থেকে নেমেই ক্যামেরাম্যানকে ভিডিও করতে বললাম। ভেঙে পড়া গাছ করাত দিয়ে কেটে বসতবাড়ি সংস্কার করার কাজে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দূর্গতরা। কথা বলছিলাম সত্তরোর্ধ স্থানীয় এক গৃহকর্তার সাথে। সে দিনের কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে, ওই বৃদ্ধ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। পাশেই আরো এক বিধবার বাড়ি, গাছ পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ঘরের ভিডিও চিত্র ও তাদের অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে কিছুটা সময় ক্ষেপন হচ্ছে। সহকর্মী আসাদ ব্যস্ততা শুরু করল। বলল, গাবুরায় চলেন, এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ওখানে গেলে ভালো ভালো ভিডিও চিত্র পাওয়া যাবে। ওখানে সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। অগত্যা ছুটে চললাম গাবুরার উদ্দেশ্যে। বুড়িগোয়ালিনী খেয়াঘাটে পৌঁছানো মাত্রই নৌকা পেয়ে গেলাম। অপর পাড়ে ডুমুরিয়া ঘাট। তিনটি মোটর সাইকেল ভাড়া করে, গাবুরা দ্বীপের লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া অজানা গন্তব্যে দৌড়াতে শুরু করলাম। পথ আর শেষ হয় না। সরু বেঁড়িবাধের উপর গাছ উপড়ে পড়ার দৃশ্য চোখে পড়লো। কিন্তু সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত বাড়ি ঘরের ভিডিও চিত্র তেমন চোখে পড়লোনা। সহকর্মী আসাদের সাথে আবারও শুরু হলো তর্ক বিতর্ক। কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে পৌছালাম চাঁদনিমুখা গ্রামে। গাবুরার ইউ পি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলমের বাড়ির সামনেই দেখা হলো,বুড়িগোয়ালিনী ইউ পি চেয়ারম্যান ভবতোষ মন্ডলের সাথে। তিনি জানালেন, বুলবুলের আঘাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত গাবুরা ইউনিয়ন। কিছুক্ষন পর এগিয়ে এলেন ইউ পি চেয়ারম্যান মাসুদুল আলম। তিনিও মুচকি হেসে ক্ষয়ক্ষতির বিবরন জানালেন। বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে,এমন দৃশ্যের ভিডিও চিত্র ধারন করতে চাই। কোন দিকে যাবো ? তিনি বললেন, গ্রামের ভিতরে যান। পড়ন্ত বিকালে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে আবারও চললাম গ্রামের ভিতরে। আবারও ওই সব গ্রামের মধ্য দিয়ে ভিন্ন পথে ডুমুরিয়া খেয়াঘাটে ফিরে আসা। ফেরার পথে চোখে পড়লো গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে বাড়ি ঘরের চাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোটা গাবুরা ইউনিয়ন ঘুরে বিধ্বস্ত এক‘শো বাড়ির ভিডিও চিত্র ধারন করা কঠিন। এরই মধ্যে ফোন পেলাম সন্ধায় সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসনের সংবাদ সম্মেলন। সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিলেন কয়েকজন সহকর্মী ও সিনিয়র সাংবাদিকগন। তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে মনে হলো, বুলবুলের ঝড়ো বেগ ভুপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ ফুট উপর দিয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়েছিল। যার কারনে উপদ্রুত অঞ্চলের বসতবাটির ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। তবে, প্রবল ঝড়ে উপকুলবর্তী অঞ্চলের অসংখ্য গাছপালা ভেঙে পড়ে। ভারী বর্ষনে চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ে জেলা প্রশাসনের ক্ষয়ক্ষতির আনুমানিক পরিসংখ্যান ১৭ হাজার সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত ও ৩৩ হাজার বাড়িঘর আংশিক বিধ্বস্তের সাথে বাস্তবতার মিল না থাকায়,বাস্তব নিজদের সচক্ষে দর্শনের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে গেলেই ঘটে যায় বিপত্তি। যদিও জেলা প্রশাসক বললেন, প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ট্যাগ অফিসারের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করে, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করা হবে। প্রেসক্লাব সভাপতি,আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যক্ষ আবু আহমেদ বললেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান বেশী দেখালে, সাতক্ষীরার মানুষ-ই বেশী সাহায্য পাবে। তাতে ক্ষতি কি ? তবে, সাতক্ষীরার মানুষের সাহায্যের জন্য যদি সত্যের অপোলাপ হয় তাহলে কোন কথা নেই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক,দৈনিক সাতনদী ও জেলা প্রতিনিধি,আর টি ভি ।