
নিজস্ব প্রতিবেদক : নিজ দল থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ ক্যাসিনো কান্ডে জড়িত হাইভোল্টেজ নেতাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশান নিয়েছে দলটি। শীর্ষ পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ শীর্ষ পর্যায়ের কিছুনেতাকেও। এরই মধ্যে আলোচনায় আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীরা। আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ ধারণ না করলেও ভোল পাল্টে সেজেছেন আওয়ামী লীগ। এদের দাপটে কোনঠাসা আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও মাঠের প্রকৃত নেতারা।
দলে অনুপ্রবেশকারী এসব বেপরোয়াদের তালিকা তৈরী করেছেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা। নিজস্ব তত্বাবধায়নে এই তালিকা করেছেন দলীয় এ সভানেত্রী। ইতোমধ্যে সেই তালিকা দলীয় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়েও পাঠিয়েছেন তিনি। সারাদেশে দেড় হাজার অনুপ্রবেশকারী বর্তমান পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব এজেন্সির মাধ্যমে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ের নেতাকর্মী ও দলীয় চেয়ারম্যানদের আমলনামা সংগ্রহ করছেন প্রধানমন্ত্রী। সংগ্রহ করছেন নেতাদের প্রতিদিনের দিনপঞ্জি। দূর্ণীতিবাজ এসব নেতাদের তালিকায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া নেতা, ভিন্ন দল থেকে অনুপ্রবেশকারী, জনগণকে হয়রানি করা নেতা। আর এ তালিকায় রয়েছে খোদ জেলা আওয়ামী লীগের পদে থাকা নেতা ও দুই এমপি। দলে যোগদান করেই মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থান পান এই নেতা। দূর্ণীতিবাজ এসব নেতাদের ব্যাংক হিসাবও অনুসন্ধানে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সাতক্ষীরা জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। টাকার বিনিময়ে আবার কখনো নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে ভিন্ন দলের নেতাদের দলে ভিড়িয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সাতক্ষীরা জেলা কমিটির উপ-প্রচার সম্পাদক প্রণব ঘোষ বাবলু। ছিলেন তালা উপজেলা ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক। দূর্নীতির দায়ে পদ থেকে বহিষ্কার হন এই বাম নেতা। মূলত বামপহ্নি নেতা হিসেবে পরিচিতি তার। স্থানীয় জনগণের ভাষ্যমতে, সন্ত্রাসের মাধ্যমেই রাজনীতিতে উত্থান ঘটে বামপহ্নি এই নেতার।
নিজ দল ওয়ার্কাস পার্টি থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেই হয়ে উঠেন বেপোরোয়া। যোগদানের পরই তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে ফাইট দিয়ে নিজের অবস্থান জাহির করে দেন। ভিন্ন দল থেকে আসা প্রণব ঘোষ বাবলু নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ও আওয়ামী লীগ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠণের নেতাকর্মীদের নিজ সমর্থনে রাখতে দলে লাগিয়ে দেন গ্রুপিং। সেই গ্রুপিংয়ে দলের অনেক পোড় খাওয়া নেতাদের প্রায় নাভিশ্বাস উঠে যায়। তবে উপজেলায় আওয়ামী লীগের তৃণমূল ত্যাগী নেতাদের মনে খুববেশী ঠাঁই পাইনি সে।
আর একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, তৎকালীন সময়ে সন্ত্রাসের অভয়ারোন্য খ্যাত এলাকা তালার খলিলনগরে চরমপহ্নির দাপট খাটিয়ে ২০০১ সালে খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন প্রণব ঘোষ। ২০১১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে এক মেয়াদে টানা ১০ বছর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে তৎকালীন ফখরুদ্দীনের তত্বাবধায়ক সরকারের সময় দূর্ণীতিবাজ প্রণব ঘোষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সরকার গঠণের পরই দেশে ফেরেন এই নেতা।
এরপর ওয়ার্কাস পার্টি থেকে বহিষ্কার হয়ে সুযোগ সন্ধানী এই নেতা ভিড়ে যান আওয়ামী লীগের বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠণে। ফিরে যায় ভাগ্য। অতীত ভুলে শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি। যার ছিটে ফোটাও কখনো তার ধারণ করা ছিল না অতীতে।
২০১৪ সালে ১৯ সেপ্টেম্বর তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পরাজিত হয়ে একটু কোণঠাসা হয়ে পড়ে প্রণব ঘোষ। কিছুদিন পরেই ম্যানেজ করে জেলা কমিটির উপ প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়ে যায় পুনরায় শুরু হয় আধিপত্যের খেলা। দলে গ্রুপিং করে তালা উপজেলা আওয়ামী লীগকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় এই অনুপ্রবেশকারী। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে দলে গড়ে তোলে নিজস্ব বলয়। অন্যদিকে, ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতিক নিয়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটে বামপহ্নি থেকে উঠে আসা এই নেতার। কিছুদিন চুপ থাকলেও সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারো শুরু করে দখল দারিত্বের খেলা। তার দখলবাজি আর আধিপত্য ধরে রাখার কৌশলটি সকলেরই জানা। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে নৌকার টিকিটের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেও দলে ঠাঁই মেলেনি অনুপ্রবেশকারী প্রণব ঘোষ বাবলুর। আওয়ামী লীগের আসন্ন জেলা ও উপজেলা সম্মেলনকে সামনে রেখে অনুপ্রবেশকারী নেতা প্রণব ঘোষ বাবলুকে তালা উপজেলা সম্মেলনকে ঘিরে উপ কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
দলে অনুপ্রবেশকারী এসব নেতাদের বিরুদ্ধে হাডলাইনে আওয়ামী লীগ। এমন খবর প্রচার হওয়া মাত্রই সাতক্ষীরার বিভিন্ন অঞ্চলে দলে অনুপ্রবেশকারীদের মাঝে আতঙ্ক শুরু হয়েছে। পদ হারানোর ভয়ে এখন থেকেই শুরু করেছেন দৌঁড়ঝাপ-তদবির।
গত শুক্রবার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর বাজারে উড়ালসড়ক নির্মাণকাজের পরিদর্শনে গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলে অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের তত্ত্বাবধানে করেছেন। এরা যেন আওয়ামী লীগের কোনো পদে আসতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে। এই তালিকায় দেড় হাজারের মতো অনুপ্রবেশকারীর নাম রয়েছে।
তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি থেকে যারা আসে, চিহ্নিত চাঁদাবাজ, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, চিহ্নিত ভূমিদস্যু, যাদের ইমেজ খারাপ, যাদের রাজনীতি জনগণের কাছে খারাপ, এই ধরনের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা প্রধানমন্ত্রী নিজের তত্ত্বাবধানে তৈরি করেছেন। তালিকাটি প্রধানমন্ত্রী দলীয় কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই তালিকা বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে সারা দেশে এখন যে সম্মেলন হচ্ছে, এই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন একটি নেতৃত্ব আসে। এই নেতৃত্বে যাতে অনুপ্রবেশকারী, বিতর্কিত বা অপকর্মকারীরা আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতৃত্বে আসতে না পারে, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন এমন কি ওয়ার্ড কমিটিতেও অনুপ্রবেশ ঘটেছে আওয়ামী লীগে। অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব নজরুল ইসলাম বলেন, দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব এজেন্সির মাধ্যমে দলে অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা করেছেন। তবে এসব বিষয়ে আমাদের অবহিত করা হয়নি। এ তালিকায় সাতক্ষীরার কতজন বা কারা রয়েছেন সেটিও এখনো জানি না। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে বেশকিছু নাম শুনেছি বা শুনছি। এদের ব্যাপারে দল থেকে এখনো কোন চিঠি আসেনি। দলের নির্দেশনা পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।