বাংলাদেশে সারাবছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার অর্ধেক হয় কোরবানির মৌসুমে। এবার করোনা ও বন্যার কারণে গত বছরের তুলনায় কোরবানি কম হওয়ায় ৩৫/৪০ শতাংশ চামড়া কম সংগ্রহ হবে বলে ধারণা করছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনবেন ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। ঢাকার বাইরে এর দাম হবে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকায় সংগ্রহ করবেন ব্যবসায়ীরা।
এ বছর গরু, ছাগল ও মহিষ সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হবে। গত বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় এক কোটি। সে হিসেবে এ বছর ৩৫ থেকে ৪০ লাখ পিস চামড়া কম সংগ্রহ হবে।
এ বছর ভলো দিক হলো লবণের সরবরাহ নিশ্চিত করায় এখনও চামড়া নষ্টের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। তবে এবারও সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম থেকে ১০ থেকে ১৫ টাকা কম দামে কাঁচা চামড়া বিক্রি হতে দেখা গেছে।
গত বছর আড়তে ‘ন্যায্য মূল্য’ না পেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় ও আবর্জনার ভাগাড়ে চামড়া ফেলে গিয়েছিলেন ফড়িয়ারা। এবার বিশ্ববাজারে চামড়ার দরপতন ও দেশিয় শিল্পগুলোর সক্ষমতা কমে যাওয়া বিবেচনায় ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা।
অন্যদিকে, খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর খাসির চামড়া ১ থেকে ২০ টাকা ও বকরির চামড়া ১৩ থেকে ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। জানা গেছে, গত বছর গরু, মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে প্রায় এক কোটি পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ বছর করোনা আর বন্যার কারণে পশু কোরবানি কমেছে৷ পশুর হাট ও পোস্তায় চামড়ার আমদানি দেখে আমাদের ধারণা, সারা দেশে এ বছর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। ফলে চামড়া সংগ্রহও এ রকমই কম হবে। ফলে এবার ৬০ থেকে ৬৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ হবে। তবে এবার সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগের ফলে একটি চামড়াও নষ্ট হয়নি।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব হোসেন বলেন, এবার দেশে করোনার মহামারির কারণে আর্থিক সংকট ও বন্যার জন্য ৩০ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। ফলে গতবারের তুলনায় ৩০ শতাংশ চামড়া কম আসবে। পোস্তা মালিকদের হিসাব মতে গত বছর কম দামের জন্য চামড়া নষ্ট হওয়ার পরও প্রায় এক কোটি পিস চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, দেশের সব চামড়াই কোনও না কোনও ভাবে সংগ্রহ হয়। আমাদের পোস্তায়তো সব চামড়া আসে না। তবে এবার আমরা একটি চামড়াও নষ্ট হতে দেইনি। যদিও আমরা সময় মতো টাকা পাইনি। কিন্তু সরকার ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নানা উদ্যোগসহ আড়তদার, ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের তৎপড়তায় সময়মতো চামড়ায় লবণ দেওয়া হয়েছে। এবার লবণের ঘাটতি ছিল না। আমরা এবার পোস্তায় সাড়ে তিন লাখ পিস চামড়া সংগ্রহ করব। পরবর্তি সময়ে আগামী দুই মাসে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করব। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বেপারিরা আমাদের আড়তে চামড়া রাখেন৷
আফতাব হোসেন বলেন, ঈদের দিন ঢাকাসহ ও এর আশেপাশের জেলাগুলো থেকে চামড়া এসেছে পোস্তায়। প্রতিটি চামড়ার মান ছিল ভালো। ফড়িয়ারা চামড়া কেনার সঙ্গে সঙ্গে লবণ দিয়েছেন। ঢাকার পোস্তায়, আমিনবাজার, সাইন্সল্যাবে এবার লবণ ছাড়া প্রতিপিস চামড়া গড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বেচা-কেনা হয়েছে। তবে দাম নিয়ে দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। সরকারি দাম অনুযায়ী প্রতিবর্গ ফুট চামড়ার দাম ৩৫-৪০ টাকা ধরে প্রতিপিস ২৫-৩০ বর্গফুট চামড়ার দাম আসে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা। আর ২০ থেকে ২৫ বর্গফুট প্রতিটি চামড়ার দাম আসে ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা।
তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে কেনার কারণ হলো, সরকার লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে৷ কিন্তু লবণছাড়া চামড়ার দাম নির্ধারণ করেনি। আমাদের একটি চামড়া কেনার পর ট্যানারি মালিকের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতি বর্গফুটে আট টাকা বাড়তি পরিবহন খরচ পড়ে। সরকারের নির্ধারিত দামের থেকে সেটা বাদ দিয়ে আমরা কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছি বা কিনেছি। কোথাও যদি এর চেয়েও কম দামে কিনে থাকে, তাহলে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
আবতাফ হোসেন আরো বলেন, চামড়ার দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় অস্পষ্টতা আছে। সরকার বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল লবণজাত চামড়ার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কাঁচা চামড়ার দরও নির্ধারণ করে দেওয়া। তাহলে চামড়ার দাম নিয়ে নৈরাজ্য হতো না। কোনও বিক্রেতার মধ্যে অসন্তোষ থাকত না। সরকার এটা না করায় কোরবানিদাতারাও মনে করছেন, সরকার নির্ধারিত দামেই ৩৫ থেকে ৪০ টাকা প্রতি বর্গফুট হিসাবে চামড়া বিক্রি করবেন৷
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, এবার করোনা, বন্যাসহ নানা কারণে প্রায় ৪০ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। ফলে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ পিস গরু, ছাগল ও মহিষের চামড়া আসবে ২০ থেকে ২৫ লাখ। সব মিলিয়ে আমরা আশা করছি, ৬০ থেকে ৬৫ লাখ পিস গরু, মহিষ ও ছাগলের চামড়া সংরক্ষণ করতে পারব। গতবছর আমরা প্রায় এক কোটি পিস চামড়া সংরক্ষণ করেছিলাম৷ এর মধ্যে গরুর চামড়া ছিল প্রায় ৬০ লাখ এবং ছাগল ও মহিষ মিলিয়ে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ পিস চামড়া সংরক্ষণ করেছিলাম।
চামড়ার কম দামের বিষয়ে তিনি বলেন, তিন-চার বছর আগে প্রতি পিস গরুর চামড়া তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। কারণ তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ছিল। বর্তমানে চামড়ার কোনও চাহিদা নেই। করোনার কারণে সারা বিশ্বেই এক প্রকার লকডাউন চলছে। পাশাপাশি কোরবানি শুধু বাংলাদেশে হয় না সারা বিশ্বেই এ সময়টায় কোরবানি হয়। ফলে সরবরাহ বেড়ে যায়। আর সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম কমে যায়। তবে আমরা সরকার নির্ধারিত লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকারটা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ও ঢাকার বাইরেরটা ২৮ থেকে ৩২ টাকা দেব। আগামী ১৫ দিন পর থেকে আমরা লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু করব। এছাড়া আমাদের কিছু ট্যানারি মালিক বিভিন্ন মাদরাসা থেকে অল্প কিছু চামড়া কিনে থাকেন, সেটার পরিমাণ মোট চামড়ার দুই থেকে তিন শতাংশ মাত্র।
পূর্বপশ্চিমবিডি/অ-ভি