বিধান চন্দ্র দাশ
আজ আমি অখন্ডিত ভারতবর্ষের দুইজন মহীয়সী নারী ও হিন্দু নারীদের অধিকার সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য উপস্থাপন করব। আঠারো শতকে নারীদের শিক্ষার কথা কল্পনা করা যায় না। নারী শিক্ষার কথা চিন্তা করাটা আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র ছিল। নারীরা শুধু পুরুষের সেবা করবে, আর সন্তান উৎপাদন করবে। নারীদের শিক্ষা তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা মেনে নেয়নি। যদি কোন নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখিয়েছে, তাকে নানা ভাবে সে সময়ে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। শিক্ষার অধিকার টুকু তারা হারিয়ে ফেলেছিল। সমাজে সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে দুই জন মহীয়সী নারী কিভাবে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন তার কিছুটা তথ্য আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরব। কাদম্বরী বসু ও চন্দ্রমুখী। এদের দুই জনের উদ্দেশ্য ছিল একই। পুরুষদের হাত থেকে বাঁচতে গেলে অর্থাৎ পুরুষ শাসিত সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে শিক্ষার বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। একমাত্র শিক্ষাই পারে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা যোগাতে এবং সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে। কাদম্বরী বসু ও চন্দ্রমুখী তৎকালীন অখন্ডিত ভারতবর্ষের দুই জন মহিলা অনেক সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সাথে সংগ্রাম করে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ১৮৭৬ সালে চন্দ্রমুখী স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরে তিনি ইংরেজি বিষয় নিয়ে এমএ পাশ করেন। কল্পনা করা যায়! চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারলে সে সময় শিক্ষিত বলা হতো। সে সময়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা যেতে। বিশ খানা গ্রাম ধরে খুজলেও একজন মেট্রিক পাশ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর স্বয়ং চন্দ্রমুখীকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং আশীর্বাদ ও করেছিলেন যে, তুমি অবহেলিত ভারতবর্ষের মানুষের পাশে দাঁড়াও। চন্দ্রমুখী পরে তার কর্মজীবনে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে নিজেকে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি কলেজে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখান থেকে শুরু করে আজীবনকাল শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত থেকে নারী সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে একজন মহাপুরুষের বাণী স্মরণ করার আগ্রহ প্রকাশ করছি।
“একজন ভালো শিক্ষক মোমবাতির মতো তিনি নিজে পুড়ে অন্যের পথ আলোকিত করেন।”
-মোস্তফা বিন আর্তাতুক।
অন্যদিকে একই সময়ে কাদম্বরী বসু ও চন্দ্রমুখী স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এই ডিগ্রী লাভ করার পরে কাদম্বরী বসু মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়ে উক্ত কলেজে ভর্তি হয়ে যান। পরে কোর্স শেষ করে কৃতিত্বের সাথে ডাক্তারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি পড়াশুনা করেন শৈল চিকিৎসক বা সার্জিক্যাল বিষয় নিয়ে। সেই সময়ে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কাদম্বরী বসু চিকিৎসা শাস্ত্রে এতই পারদর্শী ছিলেন, সে সময় অনেক বিলেতি ডাক্তার তার কাছে হার মানে। পরে দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই সময় মেয়েদের শিক্ষার কথা চিন্তা করা অত্যন্ত অকল্পনীয় বিষয় ছিল। ডাক্তার কাদম্বরী বসুকে নিয়ে মেয়েদের ডাক্তারী করা সমাজপতিরা ভালো চোখে দেখেন নি। বিভিন্ন পত্রিকায় আকথা বা কুরুচি পূর্ণ কথা, অপমান সুলভ কথা প্রচার হতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে ডাক্তার কাদম্বরী বসু পত্রিকা সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় পত্রিকা সম্পাদকের ১০০ টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের জেল হয়েছিল। পরবর্তীতে ভারতবর্ষের শাসনকর্তা ডাক্তার কাদম্বরী বসুকে ভারত রত্ম হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেন। যতদিন তিনি বেঁচে ছিলেন ততদিন গরীব দুঃখী মানুষ সহ সর্বস্তরের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন।
এখানে হিন্দু নারীদের অধিকারের বিষয়ে আমি কিছু তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করব। যা বিগত সংখ্যায় অর্থাৎ “সনাতন ধর্মীয় মতে হিন্দু নারীরা কতটুকু অধিকার ভোগ করে” এই শিরোনামে হিন্দু নারীদের অধিকারের কথা উল্লেখ করেছিলাম।
ভারত ও নেপালের নারীরা অবশ্যই পুরুষের সাথে সমানভাবে পারদর্শী। কোন অংশে নারীরা পুরুষের চেয়ে কম নয়। এজন্য ভারত ও নেপালে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির অংশ পবিত্র সংবিধানের মাধ্যমে আইন পাশ করা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশে কেন এই আইন পাশ হচ্ছে না? এদেশের নারীরা কেন উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির অংশ পাচ্ছে না। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাহলে হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার থেকে কি বঞ্চিত করে রেখেছেন? তিনি কি হিন্দু নারীদের প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণ করছেন? আর তা যদি না হয়, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সহ অন্যান্য সংগঠন গুলি এবং হিন্দু যে সব মাননীয় সংসদ সদস্য হয়েছেন, তারাই কি হিন্দু নারীদের এই নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় অন্তঃরায়। এদেশের নারীরা কি আন্দোলন করার সাহস টুকু হারিয়ে ফেলেছেন। তারা যে উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির দাবীদার এ প্রতিবাদের ভাষা টুকু-ও কি তারা হারিয়ে ফেলেছেন। আপনারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় বড় নেতা, হিন্দু নারীদের সম্পত্তির অধিকার আইন পাশ হোক এটি আপনার চান না। নির্যাতিত নারীদের পক্ষে বলা তো দুরের কথা বরং বিরোধিতা করেন। আমরা হিন্দু সম্প্রদায়, আধ্যাশক্তি মহামায়ার পূজা করি। মাতৃশক্তিকে আরাধনা করি এবং শ্রদ্ধা করি। অন্যদিকে মাতৃ জাতির উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করি। সম্পত্তির অধিকার শুধু পুরুষের বেলায়, নারীদের বেলায় নয়। এ কেমন দ্বৈতনীতি? সামনে হিন্দু সম্প্রদায়ের দূর্গা পুজা। এই দূর্গা মুর্তি আপনারা দেখেছেন তো? দশ হাতে দশ অস্ত্র। বাংলাদেশের এই বঞ্চিত নারীরা যেদিন জেগে উঠবে, তাদের নায্য অধিকার আপনারা হরণ করেছেন, তখন মা দূর্গার এক হাতের ঐ রাম দা নিয়ে আপনাদের যখন তাড়া করবে সেদিন কিন্তু ছুটেও পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না। তাই বলছি সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা করে হিন্দু নারীদের উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির বিলটি পাশ করার ব্যবস্থা করুন। জননেত্রী শেখ হাসিনা নারী উন্নয়নের জন্য অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। মাত্র কয়েকজন হিন্দু প্রতিনিধি যদি বাদ সাধেন বা এই আইনের বিরোধিতা করেন তাদের কথা উপেক্ষা করে বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের দুঃখ দুর্দশার কথা ভেবে সম্পত্তির অধিকার আইনের বিলটি পাশ করার কথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করবেন।
বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র
আমি বলি কি! স্বামী মারা যাওয়ার পর যদি এ সমস্ত বিধবা নারীদের শ্বশুর কুলের বা পিতৃকুলের সম্পত্তির অংশ পেত, তাহলে তারা মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু পেত। এখন না পাচ্ছে শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির অংশ আবার না পাচ্ছে পিতার বাড়ির সম্পত্তির অংশ। এখন এরা কোথায় যাবে? এদের উপায় কি? এদের কপালে আছে কি শুধু ভ্রাতৃবধুর ঝাটালাথি? আর যদি শ্বশুর বাড়ির গলগ্রহী হয়ে বেঁচে থাকে তাহলে শাশুড়ি ও ননদের ঝাটালাথি। ফলে এ সমস্ত নির্যাতিত নারীরা অধিকাংশ ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হচ্ছে। সুতরাং আপনাদের যুক্তি ভুল। এখন সম্পত্তির অংশ না দিয়ে কি ধর্মান্তরিত হওয়া ঠেকাতে পেরেছেন? তাদের সম্পত্তির অধিকার ফিরিয়ে দিন, দেখবেন আর ধর্মান্তরিত হবে না। প্রাচীন আমলের সেই ব্রিটিশ ঘুণে ধরা আইন বর্তমান শতাব্দীতে অচল। আর চলে না। এই কালো আইনটি বাংলাদেশে পরিবর্তন হওয়া দরকার। হিন্দু সমাজকে সকল কু সংস্কারের বেড়জাল থেকে মুক্ত করতে হবে। নারীদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আমাদের দেখতে হবে চিড়িয়াখানায়। কারণ আপনারা বড় বড় নেতারা দেখতে পাচ্ছেন না, নিম্নবর্ণের যে মানুষ গুলি যে এলাকায় বাস করে সেখানে খ্রিস্টানরা মিশন খুলে বসে আছে। তারা অবহেলিত মানুষের ঋণদান সহ সকল ছাত্রদের পোশাক-পরিচ্ছদ, বই-খাতা, আর্থিক সুবিধা দিচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাই, নির্যাতিত মানুষগুলিকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করা। দলে দলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে তারা খ্রিস্টান হচ্ছেন। আবার ঐ যে পূর্বে উল্লেখিত নির্যাতিত নারীরা অনেকেই মুসলমান হচ্ছে। এখন প্রশ্ন আজ যারা বড় বড় নেতারা বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন, এর কারণ তো আপনাদের একটাই, হিন্দু নারীরা যাতে মুসলমান না হয়। এখানে মুসলমান হওয়া থেকে তাদের বন্ধ করতে পেরেছেন কি? আপনারা কি হিন্দু ধর্মে দুই একজন মানুষকে দীক্ষিত করাতে পেরেছেন কি? যদি ভালোবেসে অন্য সম্প্রদায় থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ে দীক্ষিত হয় সেক্ষেত্রে আপনারা তাদের কি আশ্রয় দিচ্ছেন কি? না তাদেরকে একঘরে করে রেখেছেন? হিন্দু সমাজ ব্যবস্থা কি তাদের মেনে নিয়েছে? আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আপনারা তাকে আশ্রয় দেন নি। সমাজও তাকে মেনে নেয়নি। ফলে আসছে বিয়োগ আর বিয়োগ। যোগ কিন্তু হচ্ছে না। আর বর্তমান সমাজে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক তারা একটি করে সন্তান নিচ্ছে, সেদিক থেকেও সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। এজন্য পূর্বেই বলেছি, ভবিষ্যতে আমাদেরকে দেখতে হবে একদিন চিড়িয়াখানায়।
এ পৃথিবীতে দুটি জাতি। একটি নারী অন্যটি পুরুষ। উভয় উভয়ের সম্পূরক। সমাজে কেউ ছোট বড় নয়। সবাই সমান। তাহলে বাংলাদেশের হিন্দু পুরুষেরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির প্রাপ্তি হচ্ছে কিন্তু নারীরা সে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেন? তবে কি এটি অন্যায় বা অবিচার নয়? একটি জাতি, অন্য জাতির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মানে কি বেইমানী করা নয়?
আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের উদ্দেশ্যে দুটি মহা পুরুষের বাণী শুনিয়ে আমার লেখার ইতি টানার ইচ্ছা পোষণ করছি। “ক্ষমা তাকেই করো, যে ভুল করেছে কিন্তু ক্ষমা তাকে করো না, যে বেইমানী করেছে।” -চাণক্য। “শিক্ষিত বোকারা মূর্খতর বোকার চেয়ে আরও অধিকতর বোকা।” -সম্রাট নেপোলিয়ন।
লেখক: অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক।